চারশো বছরের পুরনো তুলসি চারার মেলার রং এখন অনেকটাই ফিকে।
ছোটনাগপুর থেকে নেমে আসা কেলেঘাইয়ের আদরে মাখা পটাশপুর। ভূগোল বলবে এ হল বিশাল রাঢ়, ব-দ্বীপ সমভূমি। শুধু কেলেঘাই নয়, সঙ্গে আছে বাঘাই আর অসংখ্য খাল, বিল। নদীর মিঠে জলে সম্বৃদ্ধ এই অঞ্চল ইতিহাসে নানা ভাবে ছাপ রেখেছে বহু বছর ধরে। মন্দির, মসজিদ মিলিয়ে হাজারো স্থাপত্য তার বুকে ধরে রেখেছে সেই ইতিহাস, পুরাণের গল্প আর পুরনো মানুষদের স্মৃতির মেদুরতা। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজারো পরব আর মেলায় মেশামেশি এলাকার আনন্দ-প্রাণ। মহাভারত থেকে উৎকল শাসন, হিজলির হিন্দু রাজবংশ থেকে অমর্ষি-র অমর সিংহ, নরসিংহ হয়ে মুসলমান শাসনে তাজ খাঁ ও তার পরবর্তী দুইশত বছর পর মারাঠা আমলের চিহ্ন বুকে করে আগলে রেখেছে পটাশপুর।
এই পটাশপুরের নাম নিয়ে রয়েছে অজস্র মত। পটাশপুরে একসময় ছিল বস্ত্রশিল্পের প্রসিদ্ধি। অনেকে মনে করেন প্রাচীন বস্ত্রশিল্পের স্মৃতি বহন করেই ‘পট্টবাস’ থেকে এসেছে পটাশ বা পটাশপুর নামটি। আবার বঙ্কিম মাইতির লেখা ‘‘মেদিনীপুরের স্থাননাম’’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় ১৫৫৭ সাল নাগাদ স্থানীয় ভূস্বামী অমর সিংহকে হত্যা করে এলাকার দখল নেন পীর মখদুম সাহেব। আধিপত্য কায়েম করতে তিনি নিয়মিত কামান দাগার ব্যবস্থা করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখের ভাষায় বোমার ফাটার সেই শব্দ থেকেই ‘পটাশপুর’ নামকরণ হয়ে থাকতে পারে।
আবার কৃষ্ণচন্দ্র রায়চৌধুরী তাঁর পুঁথিতে জানিয়েছেন, সপ্তদশ শতকে এলাকাটি যখন মোগল শাসনাধীন তখনই এক পীরের আস্তানাকে রাজপুত সেনারা ‘পাটোয়াস’ বলতেন। সম্ভবত ‘পট্টবাস’ কথাটি থেকে ‘পাটোয়াস’-এর উত্পত্তি। পরে মহল্লাটিকে পটাশপুর নামে পরিচিত হয়।
গোটা এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য দেব দেউল। একদিকে যেমন রয়েছে শৈব মন্দির, তেমনই রয়েছে অসংখ্য বৈষ্ণব দেউল। সে সবই মন্দির উৎকৃষ্ট টেরাকোটার কাজ নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তেমন কোনও যত্ন নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা জানেন সে সব ইতিহাস। প্রাচীন অতিবৃদ্ধেরা শোনান সে সব কাহিনী। অবহেলায় পড়ে থাকে দেব দেউল। জেলার গণ্ডী পেরিয়ে কেউ আসেন না দেখতে। কোনও আগ্রহ নেই প্রশাসনেরও।
আড়গোড়া দিঘিতে পাওয়া প্রাচীন দশ মহাবিদ্যা মূর্তি খোদাই করা পাথরের স্তম্ভ।
গোপালপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার পাথরঘাটায় কেলেঘাই নদী তীরে রয়েছে কঙ্কেশ্বর মহাদেবের মন্দির। কথিত রয়েছে অজ্ঞাতবাস কালে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির কঙ্ক নাম নিয়ে বাস করেছিলেন বিরাট রাজার গৃহে। বিরাট রাজার রাজত্ব সম্ভবত ছিল দাঁতন ও ওড়িশার মধ্যবর্তী অঞ্চলে। সে সময়ই যুধিষ্ঠির স্থাপন করেছিলেন এই শিব মন্দির। বিশালাকার কালো পাথর বয়ে এনেছিলেন স্বয়ং ভীম। কিন্তু মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় মন্দির নির্মাণ। সেই মন্দিরের ভগ্ন স্তম্ভগুলি এখনও রয়েছে মন্দির প্রাঙ্গণে। গবেষক তারাপদ সাঁতরা-র লেখা ‘পুরাকীর্তি সমীক্ষা-মেদিনীপুর’ গ্রন্থে জানা যায় ১৫১০ সালে নীলাচল যাওয়ার পথে চৈতন্যদেব, কেলেঘাই নদীপথে নেমে এখানেই এই কঙ্কেশ্বর মহাদেবের পূজা করেছিলেন।
এখন আগের সেই জৌলুস আর না থাকলেও নতুন তৈরি মন্দিরে চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজন মেলা বিশেষ দ্রষ্টব্য। এরপর বিশিষ্ট মন্দির গবেষক তারাপদ সাঁতরা-র লেখা "পুরাকীর্তি সমীক্ষা-মেদিনীপুর" নামক পুস্তক থেকে জানা যায় খ্রিষ্টীয় ১৫১০-এ নীলাচল যাওয়ারকালে চৈতন্যদেব, কেলেঘাই নদীপথে নেমে এখানেই এই কঙ্কেশ্বর মহাদেবের পূজা করেন।
এ ছাড়া পটাশপুরে আরও অনেকগুলি প্রাচীন শিব মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায় এলাকার ইতিহাসে। যেমন পচেটের খড়্গেশ্বর মহাদেব, কুতুবপুরের পঞ্চরত্ন, টুনিয়াবিলার গঙ্গাধর, মঙ্গলপুরের তিন মহাদেব, পালপাড়া শিবের থান, সাহাপুরের স্বপ্নেশ্বর শিব মন্দির।
পাশাপাশি বৈষ্ণব ধর্মস্থান হিসেবে পাথরঘাটা, গোকুলপুরের গোকুলানন্দ, তুলসিচারা এলাকা, গোপালপুরের রাধামাধব মন্দির, নইপুরের মদনমোহন মন্দির, পচেটগড়ের কিশোর রায় মন্দির, দেউলবাড়ের শ্যামচাঁদ জিউ, ব্রজবল্লভপুরের মদনমোহন জিউ-সহ বাল্যগোবিন্দপুর, ভৈরবদাঁড়ি, টেপরপাড়া প্রভৃতি এলাকার বৈষ্ণব মন্দির উল্লেখযোগ্য। এই মন্দিরগুলিতে তখনকার প্রাচীন বৈষ্ণবরীতি মেনে নির্মিত টেরাকোটা ও এলাকার বিশেষ শিল্পবোধ আজও অমলিন।
পরবর্তী কালে এই এলাকা মুসলিম শাসনাধীনে চলে যায়। তাই শৈব, বৈষ্ণব দেউলগুলির পাশেই রয়েছে অজস্র পীর-পয়গম্বরের আস্তানা, মাজার, মসজিদ।
সবচেয়ে প্রাচীন অমর্ষি-পীরের আস্তানা। এটি হিজলির অধিপতি তাজ খাঁ নির্মিত বলে জানা যায়। আজও এখনে হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে শিরনি চড়ান, প্রদীপ জ্বালেন মনোবাসনা পূরণের আশায়। প্রতি বছর চারদিন ধরে উরস উৎসব পালিত হয়। যোগ দেন উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই।
এ ছাড়া সেই পীর মখদুম সাহেবের তিন গম্বুজ মসজিদও রয়েছে এলাকায়। গবেষক যোগেশচন্দ্র বসু-র মেদিনীপুরের ইতিহাস থেকে জানা যায় মূলত মোগল আমলে তৎকালীন হিজলি অধিপতি বাহাদুর খাঁ ১৬৬০ এর পূর্বে অমর্ষিতে এই মসজিদ গড়ে তোলেন। পটাশপুরের ছয় গম্বুজ শাহী মসজিদটি সপ্তদশ শতকের প্রাচীন পুরাকীর্তি বলে জানা যায়। ১০৮৮ অব্দে পারস্যবাসী মৌলবি শাহ খোদাবক্স এটি নির্মাণ করেন। প্রসন্ন কুমার ত্রিপাঠী-র লেখা ‘পটাশপুরের কথা’ বই থেকে জানা যায় তৎকালীন দিল্লি অধিপতি ঔরঙ্গজেব এই মসজিদের জন্য ভূসম্পত্তিও দান করেন। এ ছাড়া খাড়, সাতশতমাল, পালপাড়া, খড়ুই, প্রভৃতি এলাকায় রয়েছে প্রাচীন মসজিদ ও ইদগা।
আজও প্রাচীন ঐতিহ্যের চিহ্ন বহন করে চলেছে পঁচেটগড়ের রাস মেলা। রয়েছে জব্দার রাস-সহ বিভিন্ন এলাকার জমিদার প্রবর্তিত পারিবারিক দুর্গোৎসব এখনও উদ্যাপিত হয় পুরোন কৌলিন্য নিয়েই। তবে কালের প্রবাহে হারিয়ে গেয়েছে জৌলুস।
বাল্য গোবিন্দপুর ও গোপালপুরের দুর্গোৎসব আর মেলায় এখনও ভিড় জমান স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রপ্রাচীন মেলাগুলির পাশাপাশি এখন সিংদা ও প্রতাপদিঘির বিদ্যাসাগর মেলা, খাড়ের খুদিরাম মেলা, বারুইপুরের কৃষি-বিজ্ঞান ও শিল্প মেলা, লালুয়া ও চিস্তিপুরের শিশুমেলা, ব্রজকিশোরপুর মিলন বন্ধন উৎসব, নইপুর শহিদ ভগত সিং মেলা শুরু হয়েছে।
এলাকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও প্রাচীন মেলা হল তুলসি চারার মেলা। প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন এই মেলা এখনও অমলিন। কেলেঘাই নদী বক্ষে আছে তুলসিমঞ্চ। পৌষ সংক্রান্তিতে নদী থেকে মাটি তুলে দান করেন পূণ্যার্থীরা।
—নিজস্ব চিত্র।