শহিদ স্মৃতিস্তম্ভের পাশেই পুজোর আয়োজন মহিষাদল আদি সর্বজনীনে।—নিজস্ব চিত্র।
পুজোর বয়স ৭৫। এ টুকু বললে কিছুই বলা হয়। ১৯৪২ সালের কথা। সারা দেশ তখন উত্তপ্ত ভারত ছাড়ো আন্দোলনে। মেদিনীপুরের মহিষাদল ছিল সেই আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি। সেই আবহেই পুজোর সূচনা— মহিষাদল আদি সার্বজনীন দুর্গোৎসব।
আজও মহিষাদলে শহিদ স্মৃতিস্তম্ভের পাশেই পুজোর আয়োজন করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আবেগ বিন্দুমাত্র কমেনি। ১৯৪২-এর ২১ সেপ্টেম্বর মহিষাদল থানা দখল অভিযানে যোগ দেয় বিদ্যুৎ বাহিনী, ভগিনী সেনা। ব্রিটিশ পুলিস নির্বিচারে গুলি চালায়। বহু বিপ্লবীর রক্তে ভিজে ওঠে মহিষাদলের মাটি। এর ঠিক ১৫ দিন পরে লালবাগান হাসপাতাল চত্বরে খড়ের চালায় হয় দুর্গার বোধন। উদ্যোক্তা হিসাবে ছিলেন রবীন্দ্র নাথ সিংহ, চিকিৎসক গোবিন্দ ভৌমিক, দেবেন্দ্রনাথ পট্টনায়ক, জলধর ব্যবর্ত্তা, জ্যোতিষচন্দ্র সামন্ত প্রমুখ বিপ্লবী। আসলে তাঁরা বিপ্লবী সতীশচন্দ্র সামন্ত, সুশীল ধাড়ার নির্দেশেই বিপ্লবীদের একত্রিত করতে ছেয়েছিলেন পুজোর মধ্যে দিয়ে।
‘‘ভয় ভেঙে সে পুজোয় যোগ দিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। এটাই চেয়েছিলেন সেই সময়ের বিপ্লবী নেতারা’’, বলেন মহিষাদলের আদি সার্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির সভাপতি শীতল প্রসাদ বাগ।
কেমন ছিল সেদিনের পুজো?
মণ্ডপের পাশে বসে প্রবীণ সদস্যরা জানালেন, সুতাহাটা ও হরিখালি বাজার থেকে চাল আসত, গেঁয়োখালি থেকে আসত ডাল, মহিষদল বাজার থেকে সাধারণ মানুষ শাকসব্জি দিতেন দেবীর প্রসাদ রান্নার জন্য। মহিষাদল রথ সড়কের পাশে প্রসাদ বিতরণের জন্য নির্মিত হয়েছিল বিশাল এক মাটির ভাণ্ড, যা স্থানীয় মানুষের কাছে পাকার ভ্যাট নামে পরিচিত। আজও মাটির তলায় চাপা রয়েছে আগুনঝরা ইতিহাসের সাক্ষী সেই ভ্যাট, জানালেন সাধারণ সম্পাদক কংগ্রেসচন্দ্র শীট।
পুজোর ঐতিহ্য আজও অমলিন। নবমীর মহাপুজোর শেষে হয় ফলদায়িনী কুমারী পুজা। দশমীতে লালাবগানের পুকুরে হয় বিসর্জন, ঠিক যেমন হয়েছিল আজ থেকে ৭৫ বছর আগে। মহিষাদলের রথতলায় শহীদ স্তম্ভের পাশেই এই পুজোর মণ্ডপ অবশ্য খুবই সাদামাটা, প্রতিমায় সাবেকিয়ানা। মাইকের তাণ্ডব, আড়ম্বরের জৌলুশ নেই, থিম জমক নেই। তবু মহিষাদলের সেরা পুজোগুলোর অন্যতম। প্রবীণদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন নবীনরাও। দেবাশিস মাইতি, রমেশ সাঁতরা বলেন, ছোটবেলা থেকে বড়দের কাছে শুনে আসছি এই পুজোর গুরুত্বের কথা। অবিভক্ত মেদিনীপুরের প্রথম সার্বজনীন দুর্গোৎসব। শুধু পুজো নয়।এক মহৎ উদ্দেশ্য ছিল তার। আমাদের নাম এই পুজার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় আপ্লুত।
৪২-এর ভারত ছাড় আন্দোলনের সঙ্গে এই পুজোরও প্লাটিনাম জয়ন্তী উপলক্ষে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছে। স্থানীয় প্রবীণেরা কলম ধরেছেন এই স্মরণিকায়। অধ্যাপক হরিপদ মাইতি মনে করেন, ‘‘এই আদি সার্বজনীন দুর্গোৎসব স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উজ্জ্বল অধ্যায়।’’ পরবর্তী প্রজন্মও সে কথা ভোলেনি। ষষ্ঠীর বিকেলে কলেজ পড়ুয়া অগ্নিমিতা বৈতালিক বললেন, ‘‘এই মণ্ডপের কাছে এলেই অন্য রকম একটা অনুভূতি হয়।’’