অপমৃত্যু আলু চাষির, পরিবার দুষছে অভাবকে

আলু চাষির মৃত্যু মিছিল অব্যাহত। এ বার এক আলু চাষির মৃত্যু হল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনায়। সোমবার সকালে অনুপ ঘোষাল (৩৮) নামে ওই চাষির ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় বাড়ির অদূরে গোয়ালঘর থেকে। পুলিশ দেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠায়। প্রাথমিক ভাবে অনুমান, অবসাদে আত্মঘাতী হয়েছেন ওই যুবক।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

চন্দ্রকোনা শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৫ ০০:৪৭
Share:

শোকার্ত পরিজনরা। —নিজস্ব চিত্র।

আলু চাষির মৃত্যু মিছিল অব্যাহত। এ বার এক আলু চাষির মৃত্যু হল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনায়। সোমবার সকালে অনুপ ঘোষাল (৩৮) নামে ওই চাষির ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় বাড়ির অদূরে গোয়ালঘর থেকে। পুলিশ দেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠায়। প্রাথমিক ভাবে অনুমান, অবসাদে আত্মঘাতী হয়েছেন ওই যুবক। মৃতের দাদা চন্দ্রকোনা থানায় লিখিতভাবে জানিয়েছেন, আর্থিক অনটনের জেরে অবসাদে ভুগছিলেন অনুপ। চন্দ্রকোনা-১ ব্লকের বিডিও সুরজিৎ ভড় বলেন, “ঠিক কী কারণে মৃত্যু তা জানতে তদন্ত শুরু হয়েছে।”

Advertisement

চন্দ্রকোনা থানার মানিককুণ্ডুু পঞ্চায়েতের ভবানীপুর গ্রামের বাসিন্দা অনুপ এ বার বিঘা চারেক জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। তাঁর পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে,আলু চাষের জন্য মহাজনের কাছ থেকে মোটা টাকা ধার করেছিলেন অনুপ। আলু বীজ, সার-সহ চাষের প্রয়োজনীয় সব কিছুই ধারে কিনেছিলেন তিনি। এমনকী স্ত্রী নীলিমা ঘোষালের গয়না বন্ধক রেখে মজুরের খরচ মিটিয়েছিলেন। অনুপ ঠিক কত টাকা দেনা করেছিলেন, পরিবারের লোকজন তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি। তবে স্থানীয় সূত্রে খবর, প্রায় ৮০ হাজার টাকা ধার ছিল চন্দ্রকোনার এই আলু চাষির। অনুপের মামা অশোক ঘোষ বলেন, “বেশিরভাগ জমি থেকেই আলু তোলা হয়ে গিয়েছিল ভাগ্নের। পঞ্চাশ শতাংশ আলু বিক্রিও করেছিল। কিন্তু দু’শো থেকে আড়াইশো টাকায় আলু বিক্রি হওয়ায় লাভ দূর, খরচই ওঠেনি। ধার শোধ হবে কী ভাবে, এই চিন্তায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ভাগ্নে।”

অনুপের বছর সাতেকের মেয়ে রয়েছে। গত শুক্রবার স্ত্রী নীলিমা মেয়ে অন্তরাকে নিয়ে চন্দ্রকোনা রোড সংলগ্ন গুহাইদহ গ্রামে বাপেরবাড়ি গিয়েছিলেন। সোমবার বিকেলে ফেরার কথা ছিল তাঁদের। তার আগে এ দিন ভোরেই স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পান নিলীমাদেবী। তিনি বলেন, “গত বার আলু চাষে ভাল লাভ হয়েছিল। কিন্তু এ বার দাম না পাওয়ায় আমরা চিন্তায় ছিলাম। তাই বলে আমার স্বামী এমনটা করবেন বিঝিনি।” মৃতের দাদা উপল ঘোষাল জানান, স্ত্রী বাড়িতে না থাকায় অনুপ তাঁর কাছেই খাওয়াদাওয়া করছিলেন। রবিবার রাতেও দুই ভাই এক সঙ্গে খান। উপলের কথায়, “খাওয়াদাওয়া শেষে ভাই ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে কখন যে বাড়ি থেকে বেরিয় গিয়ে এই কাণ্ড করল বুঝতেই পারলাম না।”

Advertisement

আলু চাষে বিপুল ক্ষতি আর চাষিদের মৃত্যু গত কয়েক বছর ধরে রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা সত্ত্বেও ডাল, বাদাম, তিলের মতো বিকল্প চাষে আগ্রহ দেখান না চাষিরা। ঝুঁকি নিয়েও সেই আলু চাষই করেন।

কিন্তু কেন?

চন্দ্রকোনার জাড়া পঞ্চায়েতের মাধবপুরের আলু চাষি তপন সামন্ত, মনোহরপুর পঞ্চায়েতের অভিরাম ঘোষ, বান্দিপুরের অচিন্ত্য সরকাররা বলেন, “আসলে সব জমিতে আলুর বদলে বিকল্প চাষ করার মতো পরিবেশ বা চাষিদের মানসিকতা তৈরি হয়নি। কিছু চাষি আলুর সঙ্গে নিজেদের মতো প্রয়োজনে মুগ বা বাদাম চাষ করেন। কিন্তু ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিকল্প চাষ কবে হবে বলা মুশকিল। কারণ, দাম না পেয়ে লোকসানের মুখে পড়লেও আলু ছেড়ে অন্য কোনও চাষের কথা ভাবনাতেই আসে না।”

জেলা কৃষি দফতর অবশ্য বিকল্প চাষের জন্য মাঝেমধ্যেই প্রচার চালায়। দফতরের উপ-কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) নিমাইচন্দ্র রায় বলেন, “আমরা প্রতি পঞ্চায়েতেই প্রচার চালাচ্ছি। চাষিদের বোঝানো হচ্ছে ডাল বা তৈলবীজ চাষে খরচ ও ঝক্কি দুই-ই কম, লাভও বেশি। কিন্তু আমরা তো বিকল্প চাষে কাউকে বাধ্য করতে পারি না।”

বিরোধীরা অবশ্য এই পরিস্থিতির জন্য তৃণমূল সরকারকেই দুষছে। বিজেপি নেতা ধীমান কোলের মতে, “বিকল্প চাষে উৎসাহ দিতে না পারা রাজ্য সরকারেরই গাফিলতি। আর আলু চাষের ক্ষেত্রে যদি চলতি মরসুমে রাজ্য সরকার প্রথম থেকেই বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে চাষিদের পাশে থাকত, তাহলে এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটত না। চাষিরা লাভও পেতেন।” সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য গুরুপদ দত্ত বলেন, “বাম আমলেও দাম না পাওয়া এবং ধসা রোগে আল চাষে ক্ষতি হত। কিন্তু সরকার তখন চাষিদের পাশে থাকার চেষ্টা করত। বর্তমান সরকার সেই গুরুত্ব না বোঝায় আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে।” তৃণমূলের চন্দ্রকোনা ব্লক সভাপতি চিত্ত পালের অবশ্য বক্তব্য, “যে কোনও মৃত্যুই দুঃখজনক। তবে সরকার সাধ্যমতো চাষিদের পাশে দাঁড়িয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন