বাড়ি থেকে এক বৃদ্ধ রেশন ডিলারের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হল। শুক্রবার এগরার মির্জাপুর গ্রামে সন্তোষকুমার দে (৭৭) নামে ওই ব্যক্তির দেহ উদ্ধার হয়। গত তিন দশক রেশন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সন্তোষবাবু। মৃতের পরিজনেদের দাবি, রেশনের ডিলারশিপের কাজের চাপ সামলাতে না পেরেই তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদেরও একাংশের মতে, নতুন নিয়মে রেশন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকেই চাপে ছিলেন তিনি। সেই কারণেই তিনি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সকালে বাড়িতে নিজের ঘরে দোলনার দড়ি গলায় জড়িয়ে আত্মঘাতী হন সন্তোষবাবু। মৃতের ছোট ছেলে শান্তনুবাবু এগরা থানায় লিখিতভাবে জানান, রেশন ব্যবস্থায় নতুন নিয়ম চালু হওয়ার পর থেকেই সন্তোষবাবু চাপে ছিলেন। তার জেরেই তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন। ময়না-তদন্তের জন্য মৃতদেহ কাঁথি মহকুমা হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
নয়া রেশন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর রেশন ডিলারদের ইস্তফা, গ্রাহকদের বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে বারবার। অনেক জায়গায় ডিলাররা রেশন দোকান বন্ধও রাখেন। খাদ্য সামগ্রীর বরাদ্দ বাড়়ানোর দাবিতে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, বাঁকুড়া, হুগলি ও মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার অনেক রেশন ডিলার গণ-ইস্তফাও দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরেও রেশন রোষের বলি হন তৃণমূল কর্মী সিভিক ভলান্টিয়ার জয়ন্ত সাঁতরা। এ বার নতুন রেশন ব্যবস্থার চাপ সামলাতে না পেরে ডিলারের আত্মহত্যারও অভিযোগ উঠল।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সন্তোষবাবু এগরার চোরপালিয়া বাসন্তী বিদ্যাপীঠ হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। এগরা-১ ব্লকের ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার মির্জাপুর, পুরুদা, আমদই, খালশুঁটিয়া, বরদা গ্রামের প্রায় দেড় হাজার পরিবারকে রেশন সামগ্রী সরবরাহের দায়িত্ব ছিল তাঁর। বিপত্নীক সন্তোষবাবুর দুই ছেলে। মৃতের ছোট ছেলে শান্তনুবাবু জানান, রেশন ব্যবস্থার নতুন নিয়ম নিয়ে নানা জটিলতার জেরে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁরা বাবা মহকুমা খাদ্য নিয়ামক প্রণব দের কাছে ইস্তফাপত্র জমা দেন। কিন্তু ওই ইস্তফাপত্র কার্যকর হয়নি। তাঁর দাবি, ‘‘রেশন নিয়ে গ্রাহকদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাবা সহ্য করতে পারছিলেন না। নতুন নিয়ম অনুযায়ী আরও ৫০০টি পরিবার রেশন সামগ্রী পাওয়ার দাবিদার হয়। গত সপ্তাহে কম রেশন সামগ্রী বরাদ্দ হওয়ায় অনেককে বকেয়া রসিদও দেওয়া হয়।’’ পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, সম্প্রতি সন্তোষবাবু জানতে পারেন, এই সপ্তাহেও গ্রাহক সংখ্যার তুলনায় কম রেশন সামগ্রী বরাদ্দ করা হয়েছে। তিনি এটাও বুঝতে পারেন, কম পরিমাণ সামগ্রী দিয়ে সব গ্রাহককে রেশন দেওয়া সম্ভব নয়। তাই সন্তোষবাবু মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে খাওয়ার পর শান্তনুবাবুর সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে কথাও বলেন।
আমদই গ্রামের বাসিন্দা শেখ মনিরুল হক বলেন, ‘‘ওই রেশন ডিলার ১৩ মার্চের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও চলতি সপ্তাহেও রেশন না মেলায় গ্রাহকদের ক্ষোভ হওয়া স্বাভাবিক। রেগে গিয়ে অনেকে সন্তোষবাবুকে খারাপ কথাও বলতেন।’’ মৃতের বড় ছেলে সুশান্তবাবু জানান, ‘‘বাবা প্রতিদিন ভোরেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন। তাই সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত উনি উঠছেন না দেখে ডাকাডাকি করি। সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে বাবার দেহ দেখতে পাই।’’ বাবার বয়স হয়ে যাওয়ায় ইদানীং রেশনের কিছু কাজ করে দিতেন শান্তনুবাবু। তিনি বলছেন, ‘‘নিজের ব্যবসা সামলে বাবার ডিলারশিপের কাজে সময় দিতে পারছিলাম না। বছর ছ’য়েক আগেও একই কারণে বাবা ডিলারশিপ ছাড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি।’’ শান্তনুবাবুর দাবি, ‘‘সরকারি অব্যবস্থার জন্যই বাবাকে আত্মহত্যা করতে হল।’’
মহকুমা খাদ্য নিয়ামক প্রণববাবুর বক্তব্য, ‘‘উনি ইস্তফাপত্র দেওয়ার দিন আমি জেলা দফতরে ছিলাম। তাই ওঁনাকে আরও একবার আসতে বলা হয়েছিল। ওঁনার ছেলে শান্তনুবাবুকেও বিষয়টি আবার বিবেচনা করে দেখতে বলা হয়। কারণ এলাকায় রেশন ব্যবস্থা সচল রাখতে কিছুটা সময় প্রয়োজন ছিল।’’ প্রণববাবু বলছেন, ‘‘ইস্তফাপত্র গ্রহণ করার নির্দিষ্ট কতকগুলি পদ্ধতি রয়েছে। সেই সময়টুকুও উনি দিলেন না। ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক।’’
স্থানীয় পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপ-প্রধান ননীগোপাল জানা বলেন, ‘‘কাজের পরিধি বাড়ছিল। বয়সের কারণে উনি গ্রাহকদের ঠিকমতো পরিষেবাও দিতে পারছিলেন না। ফলে চাপ একটা ছিলই।’’ পশ্চিমবঙ্গ এম আর ডিলার অ্যাসেসিয়েশনের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক মাধব পাঁজা বলেন, ‘‘সরকারি নিয়মের জটিলতায় আমরা ব্যতিব্যস্ত। আর সকলকে রেশন দেওয়ার চাপ তো রয়েইছে।’’ মাধববাবুর কথায়, ‘‘উনি এতদিন এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। খাদ্য দফতরের গড়িমসির কারণেই মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে উনি আত্মঘাতী হলেন। এই পরিস্থিতিতে সাংগঠনিক স্তরে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’’