Jhargram

হুলে বিদ্ধ সিভিক যেন ভাঙা কুলো

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এক নাবালিকার বিয়ের ঘটনায় অন্যতম মদতদাতা হিসেবে এক সিভিক ভলান্টিয়ারের নাম জড়িয়েছে। ঘটনাটি মেদিনীপুর শহরতলির। মেয়েটির বয়স তেরো।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২২ ০৭:৩৭
Share:

সিভিক ভলান্টিয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ। প্রতীকী চিত্র।

পদ পরিবর্তন হয়েছে বহুদিন। সিভিক পুলিশের বদলে তাঁরা এখন সিভিক ভলান্টিয়ার। উদয়অস্ত হাড়াভাঙা পরিশ্রমের পর মেলে সামান্য কিছু পারিশ্রমিক। সঙ্গে একরাশ দুর্নাম।

Advertisement

সপ্তাহ তিনেক আগের ঘটনা। দখল হয়ে যাওয়া লোধা-শবরদের জমি ফেরাতে গিয়েছিলেন ঝাড়গ্রাম সদরের মহকুমাশাসক। অভিযোগ, যাঁরা আদিবাসী নন, তাঁরা কখনওই আদিম জনজাতিদের জমি কিনতে পারেন না। অথচ লোধা-শবরদের প্রায় আট বিঘা জমির চরিত্র বদলে দিয়ে পুরো জমিটাই বেহাত হয়ে গিয়েছে। ভূমি দফতরের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নেমে জমি দখলের মূল দুই পাণ্ডাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ঝাড়গ্রামের রাধানগর গ্রামের বাসিন্দা ওই দুই অভিযুক্ত সম্পর্কে দাদা ও ভাই। দু’জনেই ছিলেন সিভিক ভলান্টিয়ার। ‘ছিলেন’ তবে এখন আর সিভিক পদে তাঁরা নেই। গ্রেফতার হওয়ার পরই সিভিক ভলান্টিয়ার পদ থেকে দু’জনকেই ‘ডিমোবিলাইজড’ (সাময়িক ভাবে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি) করা হয়েছে। আর এরপরই স্থানীয় মহলে প্রশ্ন উঠছে, ‘পুলিশে’র সাহায্যকারী হিসেবে কাজের সুযোগকে ব্যবহার করে কি সিভিক ভলান্টিয়ারদের একাংশ অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছেন?

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এক নাবালিকার বিয়ের ঘটনায় অন্যতম মদতদাতা হিসেবে এক সিভিক ভলান্টিয়ারের নাম জড়িয়েছে। ঘটনাটি মেদিনীপুর শহরতলির। মেয়েটির বয়স তেরো। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে সে। বিয়েতে মেয়েটি রাজি ছিল না। নাবালিকা মেয়ের বিয়েতে মত ছিল না মায়েরও। মা’কে অন্ধকারে রেখে নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছিলেন পরিবারের অন্যরা। পড়শি কয়েকজনের মদতও ছিল। অভিযোগ, মদতদাতাদের মধ্যে ছিলেন এক সিভিক ভলান্টিয়ারও। সেই সিভিকই ওই পরিবারের অন্যদের আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে, ‘‘আমি পুলিশে আছি। কিছু সমস্যা হবে না। সব ম্যানেজ করে নেব।’’

Advertisement

এক তৃণমূলকর্মীর ফেসবুক পোস্ট ঘিরে চাপানউতোর হয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরে। পোস্টটি ছিল সিভিক ভলান্টিয়ারদের উদ্দেশ্যে। জেলা তৃণমূলের এক নেতার মন্তব্য ছিল, ‘‘ওই পোস্টে যা লেখা রয়েছে, সেটা আমাদের মনের কথা।’’ পোস্টটিতে লেখা ছিল, ‘সিভিক ভাইদের বলছি, সিপিএম ও বিজেপি সুপ্রিম কোর্টে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। দিদি তোমাদের হয়ে লড়ছেন। বিগত ভোটে তোমাদের দু’-একজন দলবিরোধী কাজ করেছো। যার নুন খাচ্ছো, তার অন্তত গুণটা গাও।’

সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগের সময় পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম দুই জেলার নানা এলাকায়ও দলবাজির অভিযোগও উঠেছিল। বেছে বেছে তৃণমূল ঘনিষ্ঠদেরই এই পদে নিয়োগ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। আবার সিভিক ভলান্টিয়ার সরাসরি শাসকদলের পদ পেয়েছেন এমন উদাহরণও রয়েছে। গত সেপ্টেম্বরেই তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র খড়্গপুর-২ ব্লক সভাপতি করা হয় অতনু দে নামে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে। কয়েক বছর আগে ঝাড়গ্রাম জেলায় একটি ব্লকের যুব তৃণমূলের সভাপতি পদ পান এক সিভিক ভলান্টিয়ার। বিষয়টি জানার পর তাঁকে কাজ থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এমন উদাহরণ আরও আছে। সূত্রের খবর, যতদিন তাঁরা সক্রিয় রাজনীতিতে বা অন্য কোনও পদে থাকবেন, ততদিন তাঁরা বেতন পাবেন না।

বিরোধীদের অভিযোগ, সিভিক ভলান্টিয়ার তৃণমূলের নেতা হলে বিপদের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। কারণ, গোড়ায় প্রধানত যানশাসনে সহায়তার জন্য নিয়োগ করা হলেও সিভিকরা এখন নানা ‘গুরুদায়িত্ব’ পালন করছেন। অভিযোগ, গত পঞ্চায়েত ভোটে গ্রামেগঞ্জে কার্যত সিভিক ভলান্টিয়াররাই প্রশাসনের মুখ হয়ে উঠেছিলেন। বুথের বাইরে, ভিতরে তাঁদের দেখা গিয়েছিল। ভোটারদের লাইনে দাঁড় করানোয়, ভোটকর্মীদের সহায়তায় সিভিল ভলান্টিয়াররাই ছিলেন ভরসা। বিরোধীদের অভিযোগ, পুলিশ প্রশাসন ও শাসকদল এক হয়ে গেলে ভোটের লাইন থেকে শুরু হয় ‘বিপদ’। তৃণমূলের পশ্চিম মেদিনীপুরের কো-অর্ডিনেটর অজিত মাইতি বলেন, ‘‘কোনও সিভিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়। এটা পুলিশের ব্যাপার।’’ আর ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের সভাপতি দুলাল মুর্মু বলছেন, ‘‘অন্যায় করলে পুলিশ কাউকে রেয়াত করে না।’’ বিজেপির রাজ্য নেতা তুষার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুলিশ হোক কিংবা সিভিক ভলান্টিয়ার, কেউ তৃণমূলের নুন খায় না। জনগণের নুন খায়। ফলে, তাঁদের উচিত জনগণের গুণ গাওয়া। তৃণমূলের নয়।’’

সিভিকের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ। কিন্তু তাদের কথা শুনবে কারা? সিভিকদের একাংশের বক্তব্য, পেশার সঙ্গে সততার কোনও যোগ নেই। এটা ব্যক্তিগত বিষয়। সব পেশার মধ্যেই সৎ-অসৎ মানুষ থাকেন। শুধু সিভিকদের একতরফা ভাবে দোষারোপ করা অর্থহীন। চন্দ্রকোনার এক সিভিক ভলান্টিয়ার বলছেন, "যা কাজের চাপ পড়ে, তাতে নাওয়াখাওয়া পর্যন্ত হয় না, বেতনও তেমন কিছু মেলে না। এই দিকটা কেউ বিবেচনা করে না।’’সিভিকদের মানবিক ভূমিকারও নানা উদাহরণ রয়েছে। জামবনি থানা এলাকায় এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী পরীক্ষাকেন্দ্রে অ্যাডমিট কার্ড আনতে ভুলে গিয়েছিল। বিষয়টি জানতে পেরে বাইক নিয়ে পরীক্ষা শুরুর মুহূর্তে ওই পরীক্ষার্থীর বাড়ি অ্যাডমিট কার্ড এনে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়েছিলেন এক সিভিক ভলান্টিয়ার। শালবনি থানায় এক দরিদ্র বৃদ্ধার টাকার অভাবে ওষুধপত্র কেনা সম্ভব হচ্ছিল না। এক সিভিক ভলান্টিয়ার নিজের বেতনের টাকা দিয়ে ওষুধ কিনে দিয়েছিলেন। বেলিয়াবেড়া থানার এক সিভিক ভলান্টিয়ার রক্ত দিয়ে এক প্রসূতির জীবন বাঁচিয়েছিলেন।

আসলে সিভিকরা প্রশিক্ষণহীন। তবু আইনশৃঙ্খলা জনিত পরিস্থিতি সামলাতে হয় সিভিকদের। সেই কারণেই হয় সমস্যা। পুলিশে বহু পদ ফাঁকা। তাই পুলিশের ভরসা সিভিক।

বিরোধীদের কটাক্ষ, নামে কি এসে যায়! সিভিকদের শুধু পদ পরিবর্তন হয়েছে। স্বভাব নয়। (চলবে)

(তথ্য: বরুণ দে, অভিজিৎ চক্রবর্তী, রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য ও রঞ্জন পাল)

a

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন