একই জলে নাওয়াখাওয়া দুই-ই

পুকুরে ভর্তি কচুরি পানা। পুকুর-ঘাটে গাদা করে পড়ে রয়েছে ময়লা-আবজর্নার স্তূপ। দুর্গন্ধে টেকা দায়। অথচ, সকাল হলেই সেই পুকুর ঘাটে ভিড় এলাকার বাসিন্দাদের। কেউ স্নানে ব্যস্ত, চলছে থালা-বাসন ধোওয়া‌ থেকে জামা-কাপড় পরিষ্কারও। এই ছবি কোনও অজ গ্রামের নয়। ঘাটাল শহরের নিত্যদিনের চেনা ছবি এটা।

Advertisement

অভিজিৎ চক্রবর্তী

ঘাটাল শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৬ ০১:২৬
Share:

পুকুরের জলে চলছে বাসন মাজা ও স্নান। পুকুরে পড়ছে নর্দমার জলও (ইনসেটে)। ছবি: কৌশিক সাঁতরা।

পুকুরে ভর্তি কচুরি পানা। পুকুর-ঘাটে গাদা করে পড়ে রয়েছে ময়লা-আবজর্নার স্তূপ। দুর্গন্ধে টেকা দায়। অথচ, সকাল হলেই সেই পুকুর ঘাটে ভিড় এলাকার বাসিন্দাদের। কেউ স্নানে ব্যস্ত, চলছে থালা-বাসন ধোওয়া‌ থেকে জামা-কাপড় পরিষ্কারও। এই ছবি কোনও অজ গ্রামের নয়। ঘাটাল শহরের নিত্যদিনের চেনা ছবি এটা।

Advertisement

দিন কয়েক আগেই চন্দ্রকোনার বেলাদণ্ড গ্রামে ডায়েরিয়ায় শতাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। এখনও ওই গ্রামে বহু মানুষের চিকিৎসা চলছে। স্বাস্থ্য দফতর জানিয়ে দিয়েছেন, পুকুরের দূষিত জল থেকেই দূষণ ছড়িয়েছে। ওই গ্রামে নিকাশির ব্যবস্থা নেই। ফলে নোংরা-আবজর্না সব পুকুরে গিয়ে পড়ছে। সেই জলই ব্যবহার করছেন বেলাদণ্ড গ্রামের শতাধিক পরিবার। বেলাদণ্ড গ্রামে বন্ধ সজলধারা প্রকল্প। কিন্তু ঘাটালের মতো মহকুমার সদর শহরের ছবিটা তো তার থেকে ভিন্ন কিছু বলছে না!

পুকুরের জল ব্যবহার বন্ধ করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রচার চালাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর। এমনকী, নলকূপের জল পানীয় জল হিসাবে ব্যবহার করলেও খাবার আগে ফুটিয়ে নেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু বছরভর এই প্রচারের পরও মানুষের জীবনে তার প্রভাব কি আদৌ আছে? পুকুরের জল ব্যবহারের ট্রাডিশন এখনও সমানে চলছে। আর তার জেরে বাড়ছে পেটের নানা অসুখ। ছড়চ্ছে চর্মরোগ। ঘাটাল শহরের কৃষ্ণনগর, গম্ভীরনগর, আড়গোড়া-সহ বিভিন্ন এলাকায় এখনও পুকুরের জলই বেশি ব্যবহার করেন বাসিন্দারা। সকাল হলেই ঘাটাল শহরের শুঁড়ি পুকুর, গদার পুকুর থেকে খড়ার পুর শহরের কারক পাড়ার শোনাচাপড়ার পুকুরে ভিড় জমান বহু মানুষ।

Advertisement

পূর্ব মেদিনীপুরের ছবিটাও খুব আলাদা নয়। মঙ্গলবারই আন্ত্রিকের প্রকোপে ৫০জনের বেশী মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন খেজুরির ঘোলা বাড় গ্রামে। অসুস্থদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে স্থানীয় ব্লক কামারদা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, জল থেকেই স্থানীয় বাসিন্দারা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। পুকুরের দূষিত জল ব্যবহারের জেরে সম্প্রতি আন্ত্রিকের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল পাঁশকুড়ার পীতপুর, গোপালনগর ও দেহাটি প্রভৃতি গ্রামে। এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছিলেন, গ্রামে প্রতিটি এলাকায় পানীয় জলের জন্য নলকূপ রয়েছে। কিন্তু বাড়ির বাসনপত্র ধোয়ার জন্য পুকুরের জল ব্যবহার করা হয়। জলের ব্যবহার নিয়ে গ্রামের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে ওই এলাকায় স্বাস্থ্য শিবির করা হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি এতটুকু। পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক রশ্মি কমলের কথায়, ‘‘জলের ব্যবহার নিয়ে বাসিন্দাদের সচেতনতা বাড়াতে প্রতিটি এলাকায় প্রচার চালানো হবে। এ বিষয়ে জেলা স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ‘’।

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রর খবর, পুকুরের জলে নানা রকমের জীবাণু থাকে। ফলে ওই জল ব্যবহার করলে শরীরে দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। পুকুরের জল ব্যবহার ক্রমশ বেড়ে চলায় উদ্বেগে স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাও। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরার আক্ষেপ, ‘‘শিবির করা, লিফলেট বিলি সমানে চলছে। কিন্তু সত্যিই আমরা এখনও মানুষকে সচেতন করে উঠতে পারিনি।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আমরা আরও সতর্ক হচ্ছি। পুকুরের জল ব্যবহার বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনকেও এগিয়ে আসতে হবে। জলের অপচয় বন্ধ করতে হবে।”

প্রশ্ন, এত প্রচার সত্ত্বেও পুকুরের জল ব্যবহার কেন বন্ধ হচ্ছে না?

কয়েক বছর আগেও পুকুরের জল দিয়ে রান্না করতেন গ্রামের বাসিন্দারা। প্রচারের ফলে হয়তো অনেকে সেই রান্নার কাজে আর পুকুরের জল ব্যবহার করেন না। কিন্তু স্নান থেকে সংসারের অনেক কাজেই ভরসা এলাকার পুকুরগুলো। ঘাটাল শহরের কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা ঝুমা মালিক, মায়া মণ্ডলের কথায়, ‘‘জানি ওই জল ভাল নয়। কিন্তু আমরা এত জল কোথায় পাব। বাধ্য হয়ে নিজেদের ক্ষতি হবে জেনেও পুকুরের জলই ব্যবহার করছি।” খড়ার পুর শহরের চার নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কুমকুম কারক, শঙ্কর কারক বলেন, ‘‘বাড়িতে নলকূপ নেই। পুরসভার ট্যাপও পর্যাপ্ত নেই। তাই পুকুরই ভরসা।”

ঘাটাল শহর-সহ খড়ার পুর এলাকতেও বহু পুকুর রয়েছে। শহরের পুকুরগুলিও একেবারে নিরাপদ নয়। পরিষ্কার না হওয়ায় কচুরিপানায় ভরে রয়েছে পুকুরগুলো। আবার কোথাও শহরের সব নোংরা পুকুর পাড়ে গিয়ে ফেলা হচ্ছে। ওই সব নোংরা পুকুরেই পড়ছে। আর সেই পুকুরেই স্নান করছেন বাসিন্দারা। জেলা প্রশাসনের এক কর্তার টিপ্পনী, ‘‘জলের চাহিদা বুঝে বিকল্প ব্যবস্থা করা জরুরি।’’

ঘাটাল পুরসভার চেয়ারম্যান বিভাস ঘোষ বলেন, “শহরের মানুষ এখনও পুকুরের জল ব্যবহার করেন। আমরাও পুরসভার পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত জল সরবরাহ করতে পারিনি। এবার পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট জলাধার তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে।’’

তথ্য সহায়তা: আনন্দ মণ্ডল ও সুব্রত গুহ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন