অধরা প্রার্থীকে নিয়ে দলেই সন্ধ্যার অন্ধকার

সন্ধ্যা রায়কে সিনেমায় যেমন লাগে এক্কেবারে তেমনই লাগছে, বলো মাসি? হুঁ, চুলটা এখনও পুরো কালো! শাড়িটার রংটাও হেব্বি। দেব-কেও এই ফাঁকে কেমন দেখা হয়ে গেল! কথায় একটু হিন্দি টান আছে, না গো? হুঁ। কী লম্বা!

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৪ ০১:৫২
Share:

সন্ধ্যা রায়কে সিনেমায় যেমন লাগে এক্কেবারে তেমনই লাগছে, বলো মাসি?

Advertisement

হুঁ, চুলটা এখনও পুরো কালো! শাড়িটার রংটাও হেব্বি।

দেব-কেও এই ফাঁকে কেমন দেখা হয়ে গেল! কথায় একটু হিন্দি টান আছে, না গো?

Advertisement

হুঁ। কী লম্বা!

মমতাদির হেলিকপ্টারটা দেখেছ?

এই তো নামতেই ছুটে গিয়ে দেখে এলাম। বাব্বা, যা ধাক্কাধাক্কি!

তা হলে আর এই তাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি কেন? সবই তো দেখা হয়ে গিয়েছে। চলো, চলো, বাড়ি চলো দেকিনি!

বেলদার বাখরাবাদে সন্ধ্যা রায়ের সমর্থনে জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন সবে বক্তৃতা শুরু করেছেন, মাঠ থেকে হুড়হুড় করে লোক বেরিয়ে যাচ্ছে! জেলার তৃণমূল নেতারা যদিও তাতে পাত্তা না-দিয়ে কাঁধ ঝেড়ে বলছেন, “এই রকম হতেই পারে।” তবে অন্দরের খবর, মঞ্চে মমতা থাকাকালীন লোক চলে যাওয়ায় তাঁরা অতটা ভাবিত নন যতটা ক্রমাগত প্রকট হয়ে ওঠা দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে।

এই তো সে দিন এগরার জনসভায় এক মেজো নেতার দলবলের সঙ্গে এক সেজো নেতার দলবলের চেয়ার ছোড়াছুড়ি হয়ে গেল, তা-ও তারকা প্রার্থী সন্ধ্যা রায়ের উপস্থিতিতে। মেদিনীপুরের বৈশাখের দুপুরে বইতে থাকা লু-র থেকেও গরম দীর্ঘশ্বাস পড়ছে তৃণমূল জেলা নেতৃত্বের একটা বড় অংশের। নিজেদের মধ্যে একটু-আধটু আকচাআকচি আগে থেকে ছিলই, কিন্তু তা লাগামছাড়া হয়েছে অভিনেত্রী প্রার্থী হওয়ার পর। কেন? জেলার প্রথম সারির এক নেতা হতাশ গলায় টাকের ঘাম মুছতে-মুছতে বলেন “নন-অ্যাভেলেবিলিটি অফ দ্য প্রার্থী! চাহিদা বেশি, জোগান কম হলেই ক্রাইসিস, সিম্পল ইকনমিক থিওরি।”

এলাকায় বড়মুখ করে তারকা প্রার্থীর কথা বলে সভা ডাকা হচ্ছে, লোকে বলছে, ‘চল, সন্ধ্যা রায়কে দেখে আসি।” কিন্তু কোথায় প্রার্থী? এলাকায় মুখ থাকছে না স্থানীয় নেতাদের। ফলে প্রার্থীকে নিজেদের এলাকায় আনা নিয়ে, মঞ্চে তাঁর পাশের চেয়ারে বসা নিয়ে নিজেদের মধ্যেই মারামারি হয়ে যাচ্ছে নেতাদের। আর তাঁদের যাবতীয় রাগ গিয়ে পড়ছে এক সোনা রায়ের উপর।

তিনি আবার কিনি?

সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে কলকাতা থেকে এসেছেন। প্রার্থীর ভাই তথা সেক্রেটারি। তৃণমূল শিবিরে ফিসফাস, বাবা তারকনাথের ‘সুধা’ এখন সোনার হাতে চাবিবন্দি। তাঁর হাতেই থাকে প্রার্থীর ফোন। জেলার হেভিওয়েট নেতাদের সঙ্গেও ‘সোনাদাদা’ প্রার্থীকে দেখা করাতে চান না। জনসভায় সাধারণ মানুষ মালা দিতে চাইলে সরিয়ে দেন। অভিযোগ শুনে নির্লিপ্ত গলায় সোনা রায় বলছেন, “যে যা বলে বলুক। আমার কাছে উপরের লেভেল থেকে ইনস্ট্রাকশন আছে। দিদির বয়স হয়েছে, শরীর ভাল নেই। সবার কাছে যেতে দেওয়া বা দেখা করতে দেওয়া যাবে না।”

তিয়াত্তর পার করা সন্ধ্যা রায় ভোর সাড়ে ৪টেয় ঘুম থেকে ওঠেন। কিন্তু মেদিনীপুর শহরের রবীন্দ্রনগরের ছিমছাম পাড়ায় ‘আন্তরিক’ ফ্ল্যাটবাড়ির তেতলা থেকে অধিকাংশ দিনই বিকেল সাড়ে ৪টের আগে কোত্থাও বেরোন না। আবার রাত এগারোটা বাজলেই শুয়ে পড়েন। জেলার নেতাদের মাথায় বাজ পড়ার দশা। না দেখা করছেন, না স্ট্র্যাটেজি ঠিক করছেন!

অসহায় মুখ করে এক নেতা দুঃখের ব্যাখ্যান দিচ্ছিলেন দেবের জনপ্রিয়তার সঙ্গে তো এখনকার সন্ধ্যা রায়ের জনপ্রিয়তার কোনও তুলনা হয় না। সেই দেব পর্যন্ত টইটই করে ঘুরছেন আর আমাদের প্রার্থী বসে আছেন। কপালে দুঃখ রয়েছে। “বিশ্বাস করুন, অবাঙালি এলাকাগুলোয় প্রার্থী চেনাতে কালঘাম ছুটছে। সেই কবে আমাদের প্রার্থী ৬-৭টা হিন্দি ফিলিম করেছিলেন। সেই নামগুলো মুখস্থ করে সভায় বলছি। আসলি-নকলি, জানে-অনজানে, পূজা কে ফুল, রহগির, ধুত্তোর!” প্রার্থীর অবশ্য তুঙ্গ আত্মবিশ্বাস। বলছেন, “কিছু করতে গেলে যে সশরীরে হাজির থাকতেই হবে এমন নয়। সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, লাগাতার নজরদারিটা জরুরি।”

এই অবস্থায় উদ্ধারকর্তার ভূমিকা নিতে হয়েছে জেলা সভাপতি দীনেন রায় বা প্রদ্যোৎ ঘোষের মতো কিছু প্রথম সারির নেতাকে। পরিস্থিতি সামলাতে তাঁরা বলছেন, “প্রার্থীর পক্ষে অল্প সময়ে সব জায়গায় যাওয়া বা সবাইকে খুশি করা সম্ভব নয়।” ব্লকে-ব্লকে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিলি করা হচ্ছে ২১ দফা নির্দেশিকা লেখা লিফলেট। সেখানে বলা হচ্ছে প্রার্থী ছাড়াই দু’দিন অন্তর মিছিল-সভা করুন, ১২-১৮ ঘণ্টা নির্বাচনের কাজ করুন, সকলের সঙ্গে নম্র ব্যবহার করুন ইত্যাদি, ইত্যাদি।

এতেও নিশ্চিন্ত থাকা যাচ্ছে না। পাছে প্রার্থীকে না পেয়ে বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সভা-মিছিল বন্ধ হয়ে যায়, তাই নিচুতলার নেতাদের প্রতি নির্দেশ গিয়েছে‘ডায়েরি লিখুন!’ কী লিখবেন? প্রতিদিন কে কী জনসংযোগ কার্যক্রম করেছেন, লিখে সপ্তাহের শেষে ঊর্ধ্বতন নেতাদের দেখিয়ে সই করাতে হবে!

অনেক সাধ্যসাধনার পর সাংবাদিকেরা সন্ধ্যা রায়ের সাক্ষাৎকারের জন্য গড়পড়তা ১৫ মিনিট সময় পাচ্ছেন। পরনে পাটভাঙা গাঢ় পেঁয়াজি রঙের চওড়া পাড় তাঁতের শাড়ি, হালকা মেকআপ। তিনি এলেন। কথা বলার সময় শব্দচয়ন করেন বেছে, স্বরক্ষেপণে ভরপুর নাটকীয়তা। বললেন, “মমতা আমার থেকে বয়সে ছোট, কিন্তু ওঁকেই আমি গুরুমা মেনেছি। ওঁর হাত ধরেই রাজনীতির ক্লাসে ঢুকেছি। রাজনীতি আর অভিনয় দু’টোই তো মানুষকে নিয়ে কাজ। তাই অসুবিধা হচ্ছে না।”

বিধানসভাতেই নাকি মমতা তাঁকে দাঁড়াতে বলেছিলেন। তখন রাজি হননি। বললেন, “এ বার ও আমাকে বলল, ‘সন্ধ্যাদি আর তুমি বাড়িতে বসে থেকো না। তোমাকে আমি কাজ দেব। তুমি পারবে।’ মানুষ এখন দেখতে আসছেন, সেই যে মেয়েটি সিনেমায় গ্রামের পুকুরে সাঁতার কাটত সে মঞ্চে কী বলছে। তাঁরা আমার উপর আস্থা রাখছেন। প্রতিপক্ষ সম্পর্কে আমি সমালোচনা করব না, শুধু নিজের কাজ করব।”

শুনে রবীন্দ্রনগরেরই পার্টি অফিসে বসে মুচকি হাসেন প্রবোধ পণ্ডা। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসে ভুগছেন। দু’বেলা ইনসুলিন নেন। টেবিলে রাখা এক গ্লাস হালকা সবুজ পানীয়। কিডনি ঠিক রাখার আয়ুর্বেদিক ওষুধ। তাতে চুমুক দিয়ে বহুশ্রুত একটি কাহিনি রোমন্থন করলেন তখন উত্তমকুমার খ্যাতির মধ্যগগনে। ঠিক হল আকাশবাণী থেকে প্রচারিত মহালয়ার চণ্ডীপাঠ তাঁকে দিয়ে করানো হবে। কিন্তু জনগণ মানেনি। মানুষের রায় ছিল, উত্তমকুমার যতই উত্তমকুমার হোন না কেন, তিনি অভিনয়টাই করুন আর চণ্ডীপাঠ করুন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। যাঁকে যেটা মানায়।

এইটুকু বলে সিপিআইয়ের তিন বারের সাংসদ খানিক থামলেন।

তার পর আয়ুর্বেদিক ওষুধে আর এক চুমুক দিয়ে বললেন, “জনপ্রিয়তা দিয়ে সবকিছু হয় না। ধরুন আপনার ছেলেমেয়েকে পড়াতে এক জন এলেন। এসে বললেন, আমি পড়াতে জানি না, কিন্তু হেডমাস্টারমশাই জোর করলেন বলে এলাম। আমাকে পড়াতে দিন। তা হলে কি আপনি দেবেন? মেদিনীপুরের মানুষ এত বোকা নয়।”

প্রশ্ন করা গেল, ২০০৯ আর ২০১৪ তো এক নয়। মাঝের সময়টায় পরিবর্তনের ঝড় এসেছে। তার ওপর মেদিনীপুরে অনেক প্রতিশ্রুত কাজ না-হওয়ায় সাংসদ তহবিলের টাকা ফেরত গিয়েছে বলে বিরোধীরা অভিযোগ করছে। চোয়াল শক্ত হল আটষট্টি পার হওয়া প্রবোধবাবুর। হাঁটুতে একটা চাপড় মেরে জানালেন, সব কাজের হিসেব রয়েছে। কোনও টাকা ফেরত যায়নি। কেবল শেষ পর্যায়ে আড়াই কোটি টাকা আসেনি। কারণ, জেলাশাসক ঠিক সময়ে ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ পাঠাননি। তার পর জুড়ে দিলেন কটাক্ষ, “যাদের সঙ্গে সারদা কাণ্ডের মতো আর্থিক কেলেঙ্কারি জড়িয়ে, তারা অন্যের দিকে আঙুল তোলে কী ভাবে?”

দুই প্রতিপক্ষের বক্তব্য জানার পর কয়েক সেকেন্ড ধ্যানস্থ রইলেন কংগ্রেসের ‘ডাক্তারবাবু’ বিমল রাজ। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ চত্বরের ঠিক পিছনে কংগ্রেস পার্টি অফিস। সামনের ফাঁকা জমিতে কাঠের চেয়ার পেতে বসেছেন প্রার্থী। সবে বিকেলের প্রচার সেরে ফিরেছেন। সাদা কুর্তা-পাজামা ঘামে জবজবে। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বললেন,“ছোটবেলায় ‘প্রতিভা’ প্রবন্ধে একটি লাইন পড়েছিলাম ‘প্রতিপক্ষ যে প্রায় সমকক্ষ, ভুলিলে চলিবে না।’ কথায়-কথায় গীতা আওড়ানো বিমলবাবুর এর পরের কথাই অবশ্য, “বামফ্রন্ট ও তৃণমূল দু’দলেরই অপশাসন প্রমাণিত। দু’দলই পরগাছা। বিজেপি সাম্প্রদায়িক। দেশ বাঁচাতে দরকার কংগ্রেসকেই।”

কলকাতার টালা পার্ক থেকে সোজা মেদিনীপুর শহরের স্টেশন রোডের লোধি ভবনে আস্তানা নেওয়া প্রভাকর তিওয়ারি বিশেষ বলাবলিতেই যাচ্ছেন না, শুধু মধুর হাসছেন! মোদী হাওয়ার দৌলতে খরচের খাতা থেকে সটান লাইমলাইটে চলে এসেছেন। প্রতিপক্ষ বা সংবাদমাধ্যম সকলেরই তাঁর প্রচারে নজর রয়েছে। মিছিলে লোকও আসছে। এতেই তোফা আছেন প্রভাকর। রহস্য করে বলছেন, “গেরুয়া সুনামি আসছে। সব অঙ্ক উল্টেপাল্টে দেব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন