অবহেলায় ঝাপসা ইতিহাস, সংরক্ষণের দাবি

কথিত আছে, এই শহরের পাশ দিয়েই পুরী গিয়েছিলেন শ্রী চৈতন্য। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবও নাকি এসেছিলেন! আর স্বাধীনতা আন্দোলন পর্বে তো বিপ্লবের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ছিল মেদিনীপুর। মেদিনীপুর পুরসভাও যথেষ্ট প্রাচীন। ১৮৬৫ সালে তৈরি এই পুরসভা এ বার দেড়শো বছরে পা দিল। অথচ পুরসভার জন্মলগ্নের ইতিহাস পর্যন্ত নেই! যেটুকু নথি রয়েছে তা ১৯১৮ সাল থেকে। তার আগের ধারাবাহিক ইতিহাস গ্রথিত করার তেমন উদ্যোগ কখনই দেখা যায়নি।

Advertisement

সুমন ঘোষ

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:৩২
Share:

অতীতের সাক্ষ্যবাহী রাজা নরেন্দ্রলাল খান জল ট্যাঙ্ক।

কথিত আছে, এই শহরের পাশ দিয়েই পুরী গিয়েছিলেন শ্রী চৈতন্য। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবও নাকি এসেছিলেন! আর স্বাধীনতা আন্দোলন পর্বে তো বিপ্লবের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ছিল মেদিনীপুর।

Advertisement

মেদিনীপুর পুরসভাও যথেষ্ট প্রাচীন। ১৮৬৫ সালে তৈরি এই পুরসভা এ বার দেড়শো বছরে পা দিল। অথচ পুরসভার জন্মলগ্নের ইতিহাস পর্যন্ত নেই! যেটুকু নথি রয়েছে তা ১৯১৮ সাল থেকে। তার আগের ধারাবাহিক ইতিহাস গ্রথিত করার তেমন উদ্যোগ কখনই দেখা যায়নি। টুকরো টুকরো ছড়িয়ে থাকা যেটুকু ইতিহাস পাওয়া যায় তা ওই স্বাধীনতা আন্দোলন পর্বেরই। কিন্তু তার আগে, বিশেষ করে শহরের জন্মলগ্নের ইতিহাস অজানাই থেকে গিয়েছে। অথচ শহর জুড়ে এমন অনেক এলাকা রয়েছে যার নাম শুনলেই পিছনের ইতিহাসটা জানতে ইচ্ছে করে।

মেদিনীপুর শহরের একাধিক এলাকার নামের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে গঞ্জ শব্দটি। যেমন— সুজাগঞ্জ, নজরগঞ্জ, অলিগঞ্জ, বিবিগঞ্জ, ইস্তিরিগঞ্জ (স্ত্রী শব্দের অপভ্রংশ) প্রভৃতি। আবার বহু জায়গার নামে রয়েছে বাজার শব্দটি। একটা শহরের মধ্যে এতগুলি বাজার নামের এলাকা সচরাচর দেখা যায় না। গোলকুয়াচক থেকে যদি ধরা হয়, তাহলে প্রথমেই রয়েছে কর্নেলগোলা। তারপর খাপ্রেলবাজার, সিপাইবাজার। কর্নেল শব্দের অর্থ পদস্থ সামরিক আধিকারিক। খাপ্রেল শব্দটি এসেছে করলোরেল থেকে। শহরের কেরানিচটি এলাকাটি এখন যেখানে, তার কাছেই আবার ছিল ক্যান্টনমেন্ট।

Advertisement

গোলকুয়াচকের উল্টো দিকেও রয়েছে বহু এলাকা যার নামের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে বাজার শব্দটি। কোতোয়ালি বাজার, ছোটবাজার, বড়বাজার, সঙ্গতবাজার, সাহাভড়ং বাজার, স্কুলবাজার। সব শেষে নতুন বাজার। আবার স্টেশনের কাছে গেটবাজার। প্রতিটি বাজার এলাকার নামের সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে স্থানিক ইতিহাস। যেমন, বড়বাজারে দোকানের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি। ব্যবসাপত্তরের বহরও বেশি। সঙ্গতবাজারে আবার রয়েছে হারমোনিয়াম, তবলা-সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের দোকান। কিছু বাজার আবার বেশ প্রাচীন। যেমন, নাড়াজোলের রাজাদের তৈরি রাজাবাজার, কোতবাজার। বর্তমানে ব্যক্তিমালিকানাধীন স্কুলবাজারেরও জন্ম জমিদারি আমলে। কোতোয়ালি বাজার রয়েছে কোতোয়ালি থানার কাছেই। এই বাজারের একটা অংশের নাম আবার হাতিশালা। তা থেকে প্রশ্ন জাগে কোনও সময় কি সত্যিই এখানে হাতি থাকত?

এই সব প্রশ্নের জবাব মেলার অবশ্য কোনও উপায় নেই। কারণ, শহরের স্থানিক ইতিহাস সংরক্ষণে কোনও পদক্ষেপই কখনও করা হয়নি। শহরের প্রবীণ শিক্ষক চপল ভট্টাচার্যের আক্ষেপ, “আগে টুকরো টুকরো কিছু লেখা হয়েছিল। তবে আগাগোড়া ইতিহাস কেউ লেখেনি।” মেদিনীপুর পুরসভার প্রবীণ কাউন্সিলর শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ও মানছেন, “এই সব ইতিহাস এখন খুঁজে পাওয়ায় কঠিন। কেউ এ ব্যাপারে এগিয়ে আসে না। বড্ড আফশোস হয়।” বর্তমানে তথ্য নির্ভর লেখালিখি করেন মেদিনীপুর টাউন স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিবেকানন্দ চক্রবর্তী। তাঁর বক্তব্য, “এই ধরনের ইতিহাস সংরক্ষণ সত্যিই ভীষণ জরুরি। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই চেষ্টা করবো। অন্যদেরও উৎসাহিত করবো।”

নতুন বাজার পুরাতন ওয়ার্কশপ। এখানেই এক সময় মেরামত হত জাহাজ। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

মেদিনীপুরের যেটুকু ইতিহাস মেলে, তা ঘাঁটাঘাঁটি করলে জানা যায়— এক সময় শহর ঘেঁষা কাঁসাই নদীতে জাহাজ চলত। জাহাজ মেরামতের এক ভগ্নস্তূপও পরে মিলেছিল নদীর ধারে। সেখান থেকে ঘোড়ায় টানা ট্রেনে মাল নিয়ে যাওয়া হত মেদিনীপুর স্টেশনের কাছে। এখনও নদীর পাশাপাশি এলাকায় বাড়ি তৈরির জন্য ভিত খুঁড়তে গেলে পুরনো দিনের রেলপথের চিহ্ন নাকি মেলে। শহর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন মন্দির, মসজিদ, গির্জা, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, রামকৃষ্ণ মিশন, সৎসঙ্গের মতো প্রতিষ্ঠান। রয়েছে দেড়শো পেরনো স্কুল, কলেজ। মীরবাজার, মিঁয়াবাজার, মির্জাবাজারের মতো এলাকার নামই বুঝিয়ে দেয় অন্য সম্প্রদায়ের লোকজনের আলাদা বসতি ছিল বহুকাল ধরেই।

মেদিনীপুরের নাম মিলেছে আইন-ই-আকবরিতেও। নামমাহাত্ম্য নিয়েও রয়েছে নানা কাহিনি। কথিত আছে, এখানে নাকি মেদিনী কর নামে এক রাজা ছিলেন। তিনিই মেদিনীপুর নগরের পত্তন করেন। কারও মতে, মাদানি বাবা নামে কোনও পীর ছিলেন। তাঁর নামেও মেদিনীপুরের নাম হতে পারে। কিন্তু প্রামাণ্য নথি কোথায়? ইংরেজ শাসকদের নামের অনুষঙ্গে এই শহরে একাধিক এলাকা রয়েছে। যেমন বার্জটাউন। জেলাশাসকের বাংলোও পরিচিত হেস্টিংস হাউস নামে। কিন্তু এই নামের পিছনের ইতিহাস খোঁজার কোনও উদ্যোগই নেই। অথচ সকলেই একবাক্যে মানছেন শহরের ইতিহাস সংরক্ষণের কাজটা দ্রুত হওয়া উচিত। লিটল ম্যাগাজিন অ্যাকাদেমির ঋত্বিক ত্রিপাঠীর কথায়, “এই ধরনের কাজ হওয়া জরুরি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন