ইডলি-ধোসাতেই এখনও আটকে রেলশহর

নানা ভাষা, নানা মত। কিন্তু বিবিধের মাঝে মিল যেন খানাপিনাতেই! ইংরেজ জমানা পেরিয়ে সময়ের স্রোতে বয়ে চলা রেলশহর খড়্গপুরের পরিধি বেড়েছে। সেই সঙ্গেই বেড়েছে তেলুগু, ওড়িয়া, বিহারি, গুজরাতি, মারাঠি, তামিল, পাঞ্জাবী, বাঙালি-সহ বহু ভাষাভাষির মানুষের সংখ্যাও। তবে এই শহরে সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় রয়েছেন তেলুগু জনজাতির মানুষ।

Advertisement

দেবমাল্য বাগচি

খড়্গপুর শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৪ ০০:৩৪
Share:

খরিদায় ইডলির দোকানে ভিড়। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

নানা ভাষা, নানা মত। কিন্তু বিবিধের মাঝে মিল যেন খানাপিনাতেই!

Advertisement

ইংরেজ জমানা পেরিয়ে সময়ের স্রোতে বয়ে চলা রেলশহর খড়্গপুরের পরিধি বেড়েছে। সেই সঙ্গেই বেড়েছে তেলুগু, ওড়িয়া, বিহারি, গুজরাতি, মারাঠি, তামিল, পাঞ্জাবী, বাঙালি-সহ বহু ভাষাভাষির মানুষের সংখ্যাও। তবে এই শহরে সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় রয়েছেন তেলুগু জনজাতির মানুষ। তাই তাঁদের খাওয়া-দাওয়ার চলই যেন ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে শহরটাকে। একসময়ে পাড়ায় পাড়ায় মাথায় করে ঝুড়িতে ইডলি বিক্রি করতেন কয়েকজন তেলুগু ইডলি বিক্রেতা। এখন অবশ্য ছবিটা বদলে গিয়েছে। রেলশহরের বিভিন্ন দোকানেই সকাল-বিকেল মিলছে চিজ ধোসা, টোম্যাটো ধোসা, পনির রাভা মশালা ধোসা বা দই ইডলি, চাট ইডলি, বাটার ইডলির মতো নানা সম্ভার। চেন্নাইয়ের আন্নানগর, বিশাখাপত্তনমের জগদম্বা বা মাদুরাইয়ের সেন্ট্রাল মার্কেটের দক্ষিণী পদের সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে রেলশহরের এই খাবার।

কিন্তু একই রকম খাবারে একঘেয়েমিও আসে না কি?

Advertisement

শহরের মলে শপিংয়ের ফাঁকে সেই কথা স্বীকার করলেন খড়্গপুরের বাসিন্দা ওড়িশার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যালের ছাত্রী স্নিগ্ধা জানা। তাঁর আক্ষেপ, “কলকাতায় কত রকমের খাবার পাওয়া যায়। এখানে ঘুরে ফিরে সেই ইডলি-ধোসা। আর খুব বেশি হলে চাউমিন। কোল্ড কফি বা অন্য রকম কিছু এখানে পাওয়াই যায় না।” একা স্নিগ্ধা নন, করুণ অবস্থা শহরের ভোজন রসিক বহু বাসিন্দারই। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, শহরের বড় বড় বাজার ঢুঁড়ে ফেললেও একটা দোকান পাওয়া যাবে না যেখানে ফিসফ্রাই, ফিসফিঙ্গার অথবা বার্গার, স্যান্ডুইজ মিলবে। খুব বেশি হলে মিলতে পারে ট্রলিতে বসা চাউমিন, বিহারি ঘেঁষা ফুচকা।

রেলশহরের খাদ্যাভ্যাসের ছবিটা কিন্তু এরকম ছিল না। এক সময় শহরে ইডলি-ধোসার চল প্রায় ছিল না বললেই চলে। সেই সময়ে শহরে ছিল উত্তর ভারতীয় কাটলেট, মোগলাইয়ের মতো খাবারের প্রচলন। চাহিদা বুঝে প্রায় সত্তর বছর আগে শহরে এসে নদিয়ার শৈলেন্দ্রকুমার বিশ্বাস ‘নিউ রেস্টুরেন্ট’ নামে এক রেস্তোরাঁ খুলেছিলেন। সেখানে শুধু মিলত বাঙালি আর উত্তর ভারতীয় খানা। গোলবাজারের বুকে রমরমিয়ে চলত সেই দোকান। এখনও একইভাবে মোগলাই, কাটলেটের সেরা ঠিকানা এই রেস্তোরাঁকেই মনে করেন শহরবাসী। ঐতিহ্যের এই রেস্তোরায় এখনও পুরনো দিনের চেয়ার-টেবিল থেকে ঘড়ি-কোনওটির বদল করা হয়নি। পুরনো নিয়ম মেনেই এখনও দোকানে খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে রয়েছেন দক্ষিণ ভারতের বাসিন্দা হাফপ্যান্ট পরা কেরিয়া। আর তার থেকেও আশ্চর্যের বিষয়, এই রেস্তোরাঁর ‘মেনু’তে এখনও ঠাঁই পায়নি দক্ষিণী খাবার। জবাবে রেস্তোরাঁর উত্তরসূরী গৌতম বিশ্বাস বললেন, “আমরা ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিয়েছি। এতে ব্যবসা হয়তো আগের তুলনায় কমেছে। তবে যাঁরা এই হোটেল চেনে জানে তারা এখানেই আসেন।” সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “চেহারা আধুনিক হলেও হোটেলের আসবাব বা মেনু চিরন্তন রাখব।”

মানুষের চাহিদা অনুযায়ী যোগানের ব্যবস্থাও ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। রেলশহরের মানুষ যে স্বাদ বদলাতে চাইছেন তা আন্দাজ করেই একসময়ে চল হয়েছিল মোমোর। তবে শুধুমাত্র সালুয়াতে নেপালি ইএফআর জওয়ানদের কোয়ার্টারের আগে নো-শ্যুটিং এলাকায় মোমো সীমাবদ্ধ ছিল। এখন গোলবাজার থেকে ইন্দা-শহরের চারদিকেই ব্যাঙের ছাতার মতো মোমো বিক্রি চলছে রমরমিয়ে। শুধু স্টিম মোমোই নয়, চিকেন-ভেজ ফ্রায়েড মোমোও বিকোচ্ছে হু হু করে। আবার রেলশহরে কিছুটা হলেও মুসলিম অধিবাসীদের সুবাদে শুরু হয়েছে বিরিয়ানির চল। বহু বছর ধরে বাসস্ট্যান্ড এলাকার দু’একটি বিরিয়ানির দোকান খুললেও বিশেষ চলত না। কিন্তু বছর সাতেকের মধ্যে আবার নতুন করে জায়গা করে নিয়েছে বিরিয়ানি। খড়্গপুরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এর প্রসার এতটাই যে কোনও বড় রেস্তোরাকেও প্রতিযোগিতায় ফেলতে পারে।

নব্বইয়ের দশক থেকে আইআইটি সংলগ্ন পুরী গেটে দু’তিনটি আধুনিক রেস্তোরাঁ খোলা হয়েছিল। সেখানেই ভিড় জমাতেন শহরের মানুষ থেকে আইআইটির পড়ুয়া, অধ্যাপকরা। সত্তরের দশকে গগন নন্দী নামে সাপ ধরতে পটু এক ব্যক্তিকে আইআইটি খুশি হয়ে টাটা স্টিল ময়দানের কাছে একটি টি-স্টল করতে জমি দিয়েছিল। খোলা আকাশের নিচে কয়েকটা টেবিল পেতে চালু হয়েছিল ‘টিক্কা’ নামে একটি দোকান। জনপ্রিয় এই হোটেলের এখন খাদ্য তালিকাও লম্বা। ফুড কাউন্টারের ধাঁচেই টোকন ব্যবস্থা চালু হয়েছে সেখানে। ১৯৮৫ সালে আইআইটি ক্যাম্পাস চত্বরে গজিয়ে ওঠে আরও দু’টি রেস্তোরা।ঁ চাহিদা বুঝে বছর চারেকের মধ্যে আইআইটি-তে খুলেছে আধুনিক কফি শপ, সঙ্গে রেস্তোরাঁ ও কিছু আইসক্রিম পার্লার। কিন্তু নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে শহরের সাধারণ বাসিন্দাদের আইআইটিতে ঢোকা প্রায় অসম্ভব। ফলে সেই খাবারের সুখভোগ থেকেও বঞ্চিত রেলশহরের বাসিন্দারা। পৃথিবীর দীর্ঘতম এই খড়্গপুর স্টেশন চত্বরের ছবিটাও যে খুব আলাদা, তেমন নয়। সেখানেও বাড়-বাড়ন্ত ইডলি-ধোসারই। কালেভদ্রে মেলেও পুরি-তরকারি। কিন্তু ব্যস্ত এই স্টেশনে দাঁড়ায় অনেক ট্রেন। ফলে মানুষের চাহিদা মেটাতেও বেশ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে এই শহর।

তবে শহরে ইতালীয়, কন্টিনেন্টাল খাবারের দোকানের কোনও চিহ্নই নেই। রেলে কর্মরত ভোজনরসিক বাঙালী বিভু কানুনগোর কথায়,“ বাঙালি মানুষদের এই শহরে যেন কোনও গুরুত্বই নেই। শহরের খাদ্যাভ্যাস থেকে তো তাই যেন মনে হয়। মিশ্র সংস্কৃতির এই শহরে কী আমরা একটু আলাদা কিছু খাবারের আশা করতে পারি না?” বাসিন্দাদের চাহিদা রয়েছে। তাহলে কেন নতুন রকমের রেস্তোঁরা খোলায় কেন উদ্যোগী হচ্ছেন না স্থানীয় ব্যবসায়ীরা? ইন্দার বাসিন্দা তথা জেলা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রাজা রায় বলেন, “এই শহরের মানুষ খাওয়ার জন্য টাকা খরচ করতে প্রস্তুত। এজন্য ইন্দা এলাকায় আধুনিক রেস্তোরাঁ খোলায় অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন। তবে বাইরের নামী সংস্থাগুলি বাজার ভাল না পাওয়ার আশঙ্কায় এখনও এখানে আসতে চাইছেন না। আশা করি, আগামী পাঁচ বছরে ছবিটা বদলে যাবে।”

কলকাতা তো অনেক দূর। ছুটির কোনও এক সন্ধ্যায় কোন কফি শপে বন্ধুগের সঙ্গে আড্ডা, বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে কোনও চাইনিজ রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার সেরে ফেরা, বা মেয়েকে জন্মদিনে তার প্রিয় পিৎজা খাওয়ানোর আনন্দ কবে পাবেন এলাকার বাসিন্দারা? অপেক্ষায় রয়েছে রেলশহর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন