গ্রাম কমিটিকে এড়িয়ে সভা বসাতেন অভিযুক্ত নেতা, নালিশ তৃণমূলের

আগেও গ্রামের মানুষের নানা সমস্যার সমাধানে বৈঠক বসাতেন সালিশিতে নির্যাতিতা গৃহবধূর আত্মহত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশ্বিনী সিংহ। ফব-র জেলা সহ-সভাপতি হওয়ার সুবাদে পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুর থানার নরগ্রামে প্রভাবও ছিল অশ্বিনীবাবুর। গ্রামবাসীদের একাংশের মতে, উনি দু’পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসে সমস্যার মীমাংসা করতেন।

Advertisement

আনন্দ মণ্ডল

চণ্ডীপুর শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:২৫
Share:

আগেও গ্রামের মানুষের নানা সমস্যার সমাধানে বৈঠক বসাতেন সালিশিতে নির্যাতিতা গৃহবধূর আত্মহত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশ্বিনী সিংহ। ফব-র জেলা সহ-সভাপতি হওয়ার সুবাদে পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুর থানার নরগ্রামে প্রভাবও ছিল অশ্বিনীবাবুর। গ্রামবাসীদের একাংশের মতে, উনি দু’পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসে সমস্যার মীমাংসা করতেন।

Advertisement

মৃতার স্বামীর দাবি, নাতনির অন্নপ্রাশন উপলক্ষে শুক্রবার রাতে তাঁর স্ত্রী ও গ্রামেরই বাসিন্দা গৌর মাইতি চাকনান বাজার থেকে থালা-বাসন কিনে দু’টি সাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন। সেই সময় গ্রামের সেচ বাংলোর কাছে কয়েকজন যুবক তাঁদের পথ আটকায়। গৌরকে তাঁরা আটকে রাখলেও তাঁর স্ত্রী কোনওমতে বাড়িতে পালিয়ে আসে। ওই যুবতীর স্বামীর অভিযোগ, “কিছুক্ষণ পরেই গৌরের স্ত্রী দুর্গারানি কয়েকজনকে নিয়ে বাড়িতে চড়াও হয়।” মৃতার শাশুড়ি কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকেন। তাঁর বক্তব্য, “গত শুক্রবার রাতে বৌমা বউমা ফোন করে জানায়, কয়েকজন তাঁকে বাড়ি থেকে চুলের মুঠি ধরে বাইরে নিয়ে যায়। তখনই ওর কথা শুনে মনে হয়েছিল, বউমা কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলতে পারে।”

তবে গৌরের সঙ্গে বউমার সম্পর্কের কথা মানতে নারাজ মৃতার শাশুড়ি। তিনি বলেন, “গৌরকে কখনও বাড়িতে আসতে দেখিনি। এ ধরনের কোনও সম্পর্কের কথাও জানি না।” স্থানীয় সবিতা পণ্ডা, আভা সামন্তের কথায়, “গ্রামে কোনওদিন গৌরের সঙ্গে মৃতা যুবতীকে একসঙ্গে দেখিনি। ওদের সম্পর্ক আছে বলেও শুনিনি।” তাঁদের কথায়, “ওই দিন সন্ধ্যায় গ্রামের সেচ বাংলোর সামনে সালিশি বসেছিল। সন্ধ্যা থেকে সেখানে চিৎকার-চেঁচামেচিও শুরু হয়। আমরা সভাস্থলের অদূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও কাছে যাইনি।” এ দিন অশ্বিনীবাবুর বাড়ি গিয়ে তাঁর স্ত্রীর দেখা মেলেনি। অশ্বিনীবাবুর বউমা পিউ সিংহের কথায়, “শ্বশুর-শাশুড়ি আলাদা থাকেন। ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা হিসেবে শ্বশুরমশাই বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। ওই দিন বাড়ির কাছেই বাংলোর সামনে সালিশি সভায় চিৎকারের শব্দ শুনেছি। কিন্তু বাড়ি থেকে বের হইনি।”

Advertisement

স্থানীয় সূত্রে খবর, অশ্বিনীবাবুর বাড়ির অদূরে সেচ বাংলোর সামনে শুক্রবার সন্ধ্যায় সালিশি সভা বসে। সভায় মৃত যুবতীকে কটূক্তি, মারধর ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় বলে অভিযোগ। গৌরকেও মারধর করার অভিযোগ ওঠে। জরিমানার টাকা না দিয়ে চুল কেটে গ্রামে ঘোরানোরও হুমকি দেওয়া হয়। মৃতার স্বামীর দাবি, অপমানে শনিবার দুপুরে বাড়িতে কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হয় সে। ঘটনায় ওই দিন অশ্বিনীবাবু, গৌর, দুর্গারানি-সহ সাতজনের বিরুদ্ধে স্ত্রীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ দায়ের করেন মৃতার স্বামী। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ শনিবার রাতেই অশ্বিনীবাবু, ও দুই প্রতিবেশী অনুপ সামন্ত ও পারুল সামন্তকে গ্রেফতার করে। বাকিরা পলাতক।

সোমবার গৌরের বাড়ি গিয়ে তাঁর দেখা মেলেনি। গৌরের মা আভা মইতি বলেন, “ছেলের সঙ্গে মৃতা বধূর সম্পর্ক আছে বলে বউমা সন্দেহ করত। এ নিয়ে বাড়িতে তাঁদের দু’জনের প্রায়ই বচসা হত।” তিনি জানান, শুক্রবার রাতে বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে ছেলেকে আটকে রেখে মারধর করার খবর পাই। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। ওখানে গিয়ে দেখি, গৌরের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। অশ্বিনীবাবুও ওখানেই উপস্থিত ছিলেন।

গ্রামের সিপিএম পঞ্চায়েত সদস্যা তনুশ্রী মাইতি বলেন, “মাস তিনেক আগে গৌর মাইতির স্ত্রী দুর্গারানি আমার কাছে এসে জানায়, তাঁর স্বামীর সঙ্গে মৃতা গৃহবধূর সম্পর্ক রয়েছে। যদিও আমি ওই সম্পর্কের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চাইনি।” তনুশ্রীদেবীর অভিযোগ, “স্থানীয়দের থেকে খবর পাই, স্বামী ও মৃতা গৃহবধূকে একসঙ্গে হাতেনাতে ধরে দিতে পারলে স্থানীয় কয়েকজনকে দুর্গারানি ২০ হাজার টাকা দেওয়ার লোভও দেখায়।” তিনি জানান, শুক্রবার রাত ৯টা নাগাদ দুর্গারানি বাড়ি এসে তাঁকে বলে, সালিশি সভায় ওর স্বামীকে মারধর করা হচ্ছে। ঘটনাটি জানার জন্য কয়েকজনকে সেখানে পাঠাই। কিন্তু তাঁরা যেখানে পৌঁছনোর আগেই ভিলেজ পুলিশ গৌর ও দুর্গারানিকে থানায় নিয়ে চলে যায়। যদিও এ বিষয়ে অশ্বিনীবাবু আমাদের কিছু বলেননি।

গ্রামের প্রাক্তন তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য জয়ন্ত পাল বলেন, “গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য গ্রাম কমিটি রয়েছে। গ্রামের দক্ষিণপাড়া এলাকায় কোনও কিছু ঘটলে অশ্বিনীবাবুই গ্রাম কমিটিকে এড়িয়ে সেখানে সালিশি সভা বসাতেন। তবে সেচ বাংলোর সামনে এ ধরনের সভা আগে কখনও হয়নি।” তাঁর বক্তব্য, “সালিশি সভায় অশ্বিনীবাবুর ভূমিকা নিন্দনীয়।” ফব-র জেলা সম্পাদক গোপাল মাইতি বলেন, “অশ্বিনীবাবুর বিষয়টি নিয়ে ১ মার্চ দলের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে দলের চণ্ডীপুর নেতৃত্বের কাছে ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হবে। তার ভিত্তিতে রাজ্য নেতৃত্বের কাছে রিপোর্ট পাঠানো হবে।” পূর্ব মেদিনীপুরের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার অমিতভরত রাঠৌর বলেন, “ঘটনার অভিযোগের ভিত্তিতে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের খোঁজেও তল্লাশি চলছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন