গরু ফিরে চান গোয়ালিনি, উকিলের প্রশ্ন প্রমাণ কই

গরু কার? যে দুধ খায়, তার? না কি যে যত্নআত্তি করে, তার? প্রসন্ন গোয়ালিনীর গরু চুরির মামলায় এই বঙ্কিমী তরজা আদালতে গড়িয়েছিল। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ কথিত সেই গো-হারা পর্বেরই ‘টেক-টু’ যেন হয়ে গেল তমলুকে। মাস আড়াই আগে পোয়াতি গরু হারিয়েছিল তমলুকের পদুমবসান গ্রামের সৈয়দা বিবির। দিনভর হারা-গরু খুঁজে হয়রান। কিন্তু সে যেন স্রেফ উবে গিয়েছে। এত দিনে কেমন ফুটফুটে বাছুর হয়েছে, কেমন উপচে পড়ছে বালতি ভরা দুধ, সেই দুধ বেচে কেমন দু’পয়সা আসছে ঘরে তা ভেবে-ভেবে ঘুমের মধ্যেও চমকে উঠতেন মধ্য-চল্লিশের সৈয়দা।

Advertisement

আনন্দ মণ্ডল

তমলুক শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:২৩
Share:

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

গরু কার? যে দুধ খায়, তার? না কি যে যত্নআত্তি করে, তার?

Advertisement

প্রসন্ন গোয়ালিনীর গরু চুরির মামলায় এই বঙ্কিমী তরজা আদালতে গড়িয়েছিল। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ কথিত সেই গো-হারা পর্বেরই ‘টেক-টু’ যেন হয়ে গেল তমলুকে।

মাস আড়াই আগে পোয়াতি গরু হারিয়েছিল তমলুকের পদুমবসান গ্রামের সৈয়দা বিবির। দিনভর হারা-গরু খুঁজে হয়রান। কিন্তু সে যেন স্রেফ উবে গিয়েছে। এত দিনে কেমন ফুটফুটে বাছুর হয়েছে, কেমন উপচে পড়ছে বালতি ভরা দুধ, সেই দুধ বেচে কেমন দু’পয়সা আসছে ঘরে তা ভেবে-ভেবে ঘুমের মধ্যেও চমকে উঠতেন মধ্য-চল্লিশের সৈয়দা।

Advertisement

হওয়ারই কথা।

স্বামী অন্য গোয়ালিনির টানে ঘর ছেড়েছে কবেই। থাকার মধ্যে শুধু এক পঞ্চদশী মেয়ে। দুধ বেচেই তাঁদের পেট চলে। এখন কী ভাবে চলবে, সেই চিন্তাতেই নাওয়া-খাওয়া উঠে গিয়েছিল সৈয়দার। হঠাত্‌ই ক’দিন আগে পদুমবসানের কাছে আবাসবাড়ি এলাকায় এক বাড়ির উঠোনে গরু দেখে চমকে ওঠেন তিনি। শুধু তো গরু নয়, সঙ্গে দিব্যি বকনা বাছুর। ও যে আমারই গাই-বাছুর গো! ধড়ফড়িয়ে সোজা সে বাড়িতে ঢুকে দাবি করে বসেন সৈয়দা।

বাড়ির কর্তা মোটেও গোবেচারা লোক নন। তমলুক আদালতের ফৌজদারি উকিল ছিলেন তিনি, নাম দিলীপ সামন্ত। সদ্য তমলুক কলেজে ক্লার্ক হয়ে ঢুকেছেন। তবে লোকের কাছে এখনও ‘উকিল’ বলেই নিজের পরিচয় দেন। সৈয়দাকে দেখেই তিনি হেঁকে দেন “এ গরু যে তোমার, তার প্রমাণ কী?” সৈয়দা যত তার রং বলেন, গায়ে কোথায় ছোপ আছে জানান, উকিলবাবু বলেন, “উঁহু, কিছুই তো মিলছে না!”

শুনতে-শুনতে শেষে খেপে যান সৈয়দা, খিঁচিয়ে ওঠেন “কোথায় পেলেন আপনি এই গরু?” উকিলবাবু শান্ত ভাবেই জানান, তিনি কোথাও পাননি। গরুই বরং দড়ি ছিঁড়ে এসে তাঁর কাছে ঠাঁই নিয়েছে। সত্যিকারের মালিক এসে প্রমাণ দিলে তার হাতে গাই-বাছুর তুলে দেবেন। কিন্তু সেই প্রমাণই তো কেউ দিতে পারছে না! সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না বুঝে সৈয়দা সোজা তমলুকে আদালতে গিয়ে মামলা ঠুকেছেন। আদালতের নির্দেশে মঙ্গলবার সকালেই গাই-বাছুর উদ্ধার করে থানায় নিয়ে গিয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক থানার পুলিশ তদন্তে নেমেছে।

সকাল থেকেই থানার সামনে দাঁড়িয়ে বিচালি চিবিয়েছে দুধেল গাই। পাশেই লেজ নেড়ে খেলে বেড়িয়েছে আড়াই মাসের বাছুর। প্রসন্ন গোয়ালিনীর মামলায় সাক্ষ্য দিতে আসা আফিমখোর কমলাকান্তকে উকিল প্রশ্ন করেছিলেন, “গরু চেন কিসে?” কমলাকান্তের ছোট্ট জবাব, “হাম্বা রবে।” সেই গুরুবাক্য মেনেই একক ও সমবেত হাম্বা-ডাকে দিনভর থানা মাত করেছে গাই-বাছুর।

তমলুক থানার ওসি কৃষ্ণেন্দু প্রধান বলেন, “আপাতত ওদের কোনও নিরাপদ আস্তানায় রাখার চেষ্টা হচ্ছে।” থানা চত্বরেই দাঁড়িয়ে দিলীপবাবু বলে চলেন, “আরও অনেকে ওই গরুর খোঁজে এসেছিল, বুঝলেন? কিন্তু সৈয়দা বিবির মতো তারাও কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি। তাই আমিই যত্ন করে গরুটি রেখেছিলাম।”

গরু তবে কার? কমলাকান্ত বলেছিলেন, “দড়ি ছিঁড়িবার সময়ে কারও নয়।” সে যে কী ষোলো আনা সত্যি, সৈয়দা বিবি হাড়ে-হাড়ে টের পেয়ে গিয়েছেন। দিলীপ উকিলের বোধহয় সেই দিব্যজ্ঞান হওয়া এখনও বাকি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন