ঘরছাড়াদের ফেরাতে চিঠি সিপিএমের

পাকা বাড়ির এককোনে, ঝোপের পাশে পড়ে রয়েছে আধভাঙা পাওয়ার টিলার। পাশেই উঁকি দিচ্ছে টিউবয়েলের হাতল। দেখলেই বোঝা যায়, অনেক দিন ঝাঁট পড়েনি উঠোনে। ঘরের সবক’টি জানালা খুলে নিয়ে গিয়েছে কে বা কারা!

Advertisement

অভিজিত্‌ চক্রবর্তী

চন্দ্রকোনা শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৪ ০১:০৪
Share:

পাকা বাড়ির এককোনে, ঝোপের পাশে পড়ে রয়েছে আধভাঙা পাওয়ার টিলার। পাশেই উঁকি দিচ্ছে টিউবয়েলের হাতল। দেখলেই বোঝা যায়, অনেক দিন ঝাঁট পড়েনি উঠোনে। ঘরের সবক’টি জানালা খুলে নিয়ে গিয়েছে কে বা কারা! সেই খোলা জানলা দিয়েই উধাও হয়ে গিয়েছে বাড়ির আসবাব-সহ ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিস।

Advertisement

পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা শহর থেকে গাছশীতলা হয়ে পলাশচাপড়ির রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই সিমলা। এই গ্রামেই বাড়ি নির্মল মুখোপাধ্যায়ের। তিনি স্থানীয় বসনছড়া লোকাল কমিটির সদস্য। গত তিন দিন ধরে ৮৮ বছরের বৃদ্ধা মা এবং স্ত্রীকে নিয়ে কার্যত পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। নির্মলবাবুর অভিযোগ, লোকসভা ভোটে সিপিএমের হয়ে সক্রিয় ভাবে প্রচার করেই সপরিবারে ঘরছাড়া হতে হয়েছে তাঁকে। ঘরদোর ভাঙচুরের পাশাপাশি লুঠ করা হয়েছে বাড়ির আসবাব-সহ নানা জিনিস। এখনও ঝাড়া হয়ে ওঠেনি মাঠের ধান।

সিপিএমের চন্দ্রকোনা ২ জোনাল কমিটির সম্পাদক তথা চন্দ্রকোনার চারবারের বিধায়ক গুরুপদ দত্তের অভিযোগ, লোকসভা নির্বাচনের পরে শুধু চন্দ্রকোনা বিধানসভা এলাকাতেই নেতা-কর্মী কিংবা সমর্থক মিলিয়ে সাড়ে চারশোরও বেশি ঘরছাড়া রয়েছেন। গত মঙ্গলবার দলের তরফে সুনির্দিষ্ট ভাবে ঘরছাড়া পরিবারের সংখ্যা এবং গ্রামের নাম উল্লেখ করে তাঁদের ঘরে ফেরাতে ঘাটালের মহকুমাশাসক, থানায় লিখিত ভাবে দাবি জানানো হয়েছে। এলাকাগুলির মধ্যে রয়েছে চন্দ্রকোনা বিধানসভা এলাকার ধান্যগাছি, দামোদরপুর, টুকুরিয়া, কুঁয়াপুর-সহ প্রায় ২০-২৫টি গ্রামের সাড়ে চারশো মানুষ। ঘাটালের মহকুমাশাসক অদীপ রায় জানিয়েছেন, তিনি অভিযোগ পেয়ে ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট থানা, বিডিওদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন।

Advertisement

বামফ্রন্টের তরফে ঘরছাড়াদের ঘরে ফেরানোর দাবি নতুন নয়। লোকসভার আগেও দুই মেদিনীপুরেই ঘরছাড়াদের ফেরানোর দাবি উঠেছিল। রাজ্যের নানা জায়গায় ফের এই দাবি উঠেছে লোকসভার পরেও। কিন্তু, চন্দ্রকোনার মতো এমন সুনির্দিষ্ট তালিকা আগে নজরে আসেনি।

সদ্য শেষ হওয়া লোকসভা ভোটে হুগলির আরামবাগ কেন্দ্রের অর্ন্তগত চন্দ্রকোনায় জোরকদমে প্রচার চালিয়েছিল সিপিএম। এর জেরে এলাকায় একাধিকবার সংঘর্ষও হয়েছে। প্রাণহানিও ঘটেছে। এলাকায় বিধায়ক ছায়া দোলুই সিপিএমের। বেশ কয়েকবার এলাকায় প্রচারে যান বামপ্রার্থী শক্তিমোহন মালিকও। সব মিলিয়ে, এলাকায় ভাল সংগঠন থাকায় ভোট-প্রচারে রীতিমতো টক্কর দিতে দেখা গিয়েছিল সিপিএমকে। কিন্তু, তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। ভোটের ফল বের হলে দেখা যায়, এই বিধানসভা এলাকায় ৩৫ হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে গিয়েছে তৃণমূল।

সিপিএমের অভিযোগ, ভোটের ভাল ফলের পরে রীতিমতো পরিকল্পিত ‘অত্যাচার’ চালাচ্ছে তৃণমূল। এর জেরে ভোটের পরেই ঘরছাড়া হন কয়েক হাজার সিপিএম সমর্থক। চন্দ্রকোনা ১ ব্লকের জোনাল কমিটির সম্পাদক বিদ্যুত্‌ রায়ের অভিযোগ, এঁদের অনেকেই রীতিমতো জরিমানা দিয়ে এলাকায় ফিরেছেন। সিপিএমের সঙ্গে কোনও সংশ্রব রাখবেন না, অনেক কর্মী বাধ্য হয়ে এমন মুচলেখাও দিয়েছেন। বসনছড়া লোকাল কমিটির সদস্য নির্মলবাবুর অভিযোগ, “তৃণমূল আমায় ফতোয়া দিয়েছিল ৩০ ভরি সোনা দিতে হবে। এ ভাবে মাথা নুইয়ে ঘরে ফিরতে চাইনি।” আরও অনেকের মতো সপরিবার ঘরছাড়া রয়েছেন চন্দ্রকোনার মনোহরপুর ১-এর হিজলির বাসিন্দা তথা প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য উমা সাঁতরাও।

এলাকার সিপিএমের কর্মী-সমর্থকের একাংশ যে এখনও ঘরছাড়া, তা মানছেন চন্দ্রকোনা ১ ও ২ ব্লকের সভাপতিরা। ব্লক সভাপতি সুকুমার চক্রবর্তী, অমিতাভ কুশারীদের বক্তব্য, “সিপিএমের কিছু লোক ঘরছাড়া বলে শুনেছি।” তবে এর সঙ্গে দল জড়িত নয় বলে তাঁদের সাফাই। তবে স্থানীয়দের একাংশের দাবি, এলাকায় তৃণমূল নেতৃত্বের উপরে দলের উপরতলার নেতাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। অভিযোগ, তারই সুযোগ নিচ্ছেন চন্দ্রকোনার তৃণমূলের একাংশ কর্মী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলাস্তরের প্রথম সারির এক নেতা কবুল করছেন, শুধু চন্দ্রকোনাই নয়, গোটা জেলা জুড়েই একই চিত্র। জরিমানা থেকে মারধর, বাড়ি ছাড়ার হুমকি সবই চলছে। আমরা ব্লক সভাপতিদের বিষয়টি বন্ধ করতে নির্দেশও দিয়েছি। কিন্তু হয়নি। এ বার কড়া ব্যবস্থা নেব।

যদিও জেলা সভাপতি দীনেন রায়ের দাবি, “এমন অভিযোগের কিছু মাত্র সত্যতা থাকলে কাউকে রেয়াত করব না। আমরা চাই না, কেউ ঘর ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করুক।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন