সরকারি হোমে আবাসিকদের হেনস্থার অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এ বার তিন আবাসিক কিশোরীর চুল কেটে শাস্তি দেওয়ার অভিযোগ উঠল হোম কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। মেদিনীপুর শহরের বিদ্যাসাগর বালিকা ভবনের এই ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন খোদ হোমের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলাশাসক সুশান্ত চক্রবর্তীও। তিনি বলেন, “হোমে তিন কিশোরীর চুল কাটার ঘটনা ঘটেছে। আমরা সমাজ কল্যাণ দফতরের কাছে তদন্ত রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছি।”
জেলা সমাজ কল্যাণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে এক কিশোরী ভারতে চলে এসেছিল। বেআইনি অনুপ্রবেশের দায়ে ওই কিশোরীকে জেলে রাখার নির্দেশ দেয় আদালত। নাবালিকা হওয়ায় ওই কিশোরীর ঠাঁই হয় মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বালিকা ভবনে। ওই হোমের কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, দিন কয়েক আগে ওই কিশোরীর প্ররোচনাতে ১৫ থেকে ১৭ বছরের আরও তিন আবাসিক কিশোরী পালানোর ছক কষছিল। সেই খবর পৌঁছায় হোমের সোশ্যাল ওয়ার্কার রূপালি সিংহ রায়ের কাছে। গত ২৩ মার্চ হোমের সব আবাসিককে ডেকে রূপালিদেবী জানান, এমন চক্রান্ত বরদাস্ত করা হবে না। ভবিষ্যতে যাতে কেউ এই ধরনের পরিকল্পনার কথাও না ভাবতে পারে তাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এরপরই তিনি আবাসনের এক কর্মীকে ওই চার কিশোরীর চুল কেটে নেওয়ার নিদান নেন।
ওই সরকারি হোমের আবাসিকদের থেকে জানা গিয়েছে, শাস্তির কথা শুনে ওই বাংলাদেশি তরুণী সকলকে ঠেলে পালিয়ে যায়। তবে হাতে-পায়ে ধরেও শাস্তির হাত থেকে বাঁচেনি বাকি তিন কিশোরী। তাদের ধরে খাবলা খাবলা করে মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়। ওই অবস্থায় দেখতে খারাপ লাগায় পরে তিন জনকেই ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। এই খবর প্রশাসনিক কর্তাদের কানে পৌঁছতে সময় লেগে যায় আরও ২ দিন। গত ২৫ মার্চ ঘটনা জানতে পেরে তদন্তের নির্দেশ দেয় প্রশাসন। তদন্ত রিপোর্ট সমাজ কল্যাণ দফতরের ডিরেক্টরের কাছেও পাঠানো হয়েছে। কেন এমন শাস্তি? যিনি এই বিধান দিয়েছেন সেই রূপালিদেবীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা যায়নি। কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি জেলা সমাজ কল্যাণ আধিকারিক প্রবীর সামন্তও। আর হোমের সহকারী সুপার কাকলি রায় বলেন, “আমি ওইদিন ছুটিতে ছিলাম। ঠিক কী হয়েছে তা বলতে পারব না।”
সরকারি হোমে আবাসিক হেনস্থা, আবাসিক মৃত্যু নিয়ে রাজ্যে শোরগোল পড়েছে এর আগেও। ২০১২ সালের ১১ জুলাই গুড়াপের ‘দুলাল স্মৃতি সংসদ’ হোমের পাঁচিলের পাশের মাটি খুঁড়ে মানসিক ভারসাম্যহীন আবাসিক যুবতী গুড়িয়ার পচাগলা দেহ উদ্ধার হয়। যুবতীকে খুনের অভিযোগে হোমের সম্পাদক উদয়চাঁদ কুুমার-সহ ৩ জনকে ধরা হয়।
মেদিনীপুরের এই হোমের ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়। মাঝে মাঝেই কিশোরী পালানোর ঘটনা ঘটেছে। এখন হোমে আধিকারিকের সংখ্যাও কম। নেই স্থায়ী সুপারিনটেনডেন্ট। একজন সিডিপিওকে অস্থায়ীভাবে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে তিনি নিয়মিত হোমে আসতে পারেন না। সেই সুযোগে প্রশিক্ষণহীন সমাজ কর্মীরাই সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছেন।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, রুপালি সিংহ রায় নামে ওই কর্মী আদপে জেলা পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্মী ছিলেন। অফিসটি কয়েক বছর আগে মেদিনীপুর থেকে খড়্গপুরে স্থানান্তরিত হওয়ায় তাঁকে হোমের কাজে নিযুক্ত করা হয়। সমাজ কল্যাণ দফতর সূত্রে খবর, ওই কর্মী হোমে একাধিপত্য চালাতেন। আধিকারিকদেরও মানতেন না। এমনকি এই শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই তিনি নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তদন্তে উঠে আসা যাবতীয় তথ্যের পাশাপাশি ওই কর্মীকে যাতে অবিলম্বে এই হোম থেকে বদলি করা হয় জেলা সমাজ কল্যাণ দফতরের পক্ষ থেকে রাজ্যের কাছে সেই প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে রিপোর্টে। ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে সে জন্য পদস্থ আধিকারিকদের নিয়মিত হোম পরিদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন।