হকারদের দখলে রাস্তার দু’ধার। ফুটপাথ না থাকায় অগত্যা রাস্তা দিয়েই হাঁটতে বাধ্য হন পথচারীরা। গাড়ি পার্কিংয়ের জেরে আরও সঙ্কীর্ণ হয়েছে রাস্তা। ফলে যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাও রয়েছে। মেদিনীপুরের এলআইসি মোড়ের রাস্তা।
দেখতে দেখতে দেড়শো বছরে পা দিল মেদিনীপুর পুরসভা। অথচ, এখনও পুর-এলাকার কোনও রাস্তাতেই ফুটপাথ তৈরি হল না!
দ্রুত বদলাচ্ছে সময়। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহন থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি। শহরে গাড়ির সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে রাস্তা পার হতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। ট্রাফিক সিগন্যালে দেড় মিনিটের মধ্যেই দেড়শো গাড়ি লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। প্রতিদিনই এ ভাবে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। রাস্তার ধারে হকার বসায় সঙ্কুচিত হচ্ছে রাস্তা। দুইয়ের মাঝে জেরবার হচ্ছেন পথচারীরা। দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়েই পথ চলছেন অনেকে। তা সত্ত্বেও শহরের প্রধান রাস্তাগুলিতে ফুটপাত তৈরিতে উদ্যোগী হয়নি কেউই।
এমন নয় যে বিষয়টি সকলের অজানা। পুরসভার প্রতিনিধিরা শহরেই বসবাস করেন, প্রশাসনের বড় কর্তারাও থাকেন এখানেই। তবু হয়নি! সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মেদিনীপুর এসেছিলেন। ১৪ জুলাই কনভয়ে মেদিনীপুর শহরের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় এই বিষয়টি তাঁর নজর এড়ায়নি। সঙ্গে সঙ্গে পুরপ্রধান প্রণব বসু ও মেদিনীপুর-খড়্গপুর উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান মৃগেন মাইতিকে নির্দেশ দেন, দ্রুত ফুটপাত তৈরি করার। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল, পরের বার তিনি যখন আসবেন তখন যেন দেখেন ফুটপাথ হয়ে গিয়েছে। তারপর সকলের টনক নড়ে।
শহরের রিং রোড তো রয়েছেই, তারই সঙ্গে কেরানীতলা থেকে জজ কোর্ট, কেরানীতলা থেকে স্টেশন, কালেক্টরেট মোড় থেকে বাসস্ট্যান্ড-সহ গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় ফুটপাথ তৈরির জন্য পদক্ষেপ করা হয়েছে। পুরপ্রধান প্রণব বসু বলেন, “পরিকল্পনা তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রায় ২ কোটি টাকা খরচ হবে। সেটি ভেটিং করানো বাকি। ভেটিং হলেই রাজ্যের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হবে।” শহরবাসী এই উদ্যোগে খুশি। তারই সঙ্গে সকলের দাবি একটাই, দ্রুত গতিতে তৈরি হোক ফুটপাথ।
কেন? মেদিনীপুরের বাসিন্দা গোপাল দাসের কথায়, “প্রতিদিন প্রাণ হাতে রাস্তায় বের হতে কার ভাল লাগে বলুন তো! দু’দিকে বেআইনি দখলদার, দ্রুত ছুটছে বাস, লরি, ট্যাক্সি। কে যে কখন কাকে চাপা দেয়! রাস্তায় বেরোলেই আতঙ্কে থাকি।” এই আতঙ্ক ও আশঙ্কা অমূলক নয়। দ্রুত গতিতে ছুটছে বাস, লরি, অটো রিকশা। পাল্লা দিয়ে চলেছে সাইকেল, মোটর বাইক, রিকশা। দু’দিকের রাস্তা দখল করে গজিয়ে উঠেছে গাড়ি সারানোর গ্যারাজ, জামা-কাপড়-জুতোর দোকান, ফাস্ট ফুড, ফুচকা স্টল, গুমটি। দোকানের সামনে আবার চেয়ার পাতা। খদ্দের বসার জন্য। তাঁরা আবার সাইকেল, মোটর বাইক বা গাড়িতে যাচ্ছেন। সেটিও থাকছে রাস্তার মাঝে। তা হলে চলার জায়গা কই?
মেদিনীপুরের হসপিটাল রোডের ছবি। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
এই পরিস্থিতিতে বহু কষ্টে পাশ কাটিয়ে কোনও রকমে চলেছেন শ’য়ে শ’য়ে পথচারী। উপায় কী? বাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মেদিনীপুর শহরের উপর দিয়ে সারাদিনে চারশো বাস চলে। তার মধ্যে কিছু বাস তিন-চার বার ঢোকে-বেরোয়। অর্থাৎ যানজটের হিসাবে সারাদিনে প্রায় এক হাজার বার বাস ঢোকে-বেরোয়। এ ছাড়া রয়েছে অটো রিকশা। তার সংখ্যাও প্রায় ৩৫০। পুরসভার অনুমতি দেওয়া রিকশার সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। বিনা অনুমতিতে আরও হাজার দু’য়েক রিকশা চলে। আর ব্যক্তিগত চার চাকা ও দু’চাকার তো ইয়ত্তা নেই। এখন প্রায় প্রতি বাড়িতেই মোটর সাইকেল রয়েছে। কিছু বাড়িতে একাধিক। এ ছাড়া শহরে বসবাসকারী প্রায় এক তৃতীয়াংশ পরিবারেই চার চাকার যান রয়েছে। বাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের জেলা সাধারণ সম্পাদক মৃগাঙ্ক মাইতির পর্যবেক্ষণ, “অবিলম্বে ফুটপাত তৈরি প্রয়োজন। নতুবা দুর্ঘটনা এড়ানো ভীষণ কঠিন হবে।” একই অভিমত প্রাক্তন উপপুরপ্রধান তথা তৃণমূলের জেলা কাযর্করী সভাপতি আশিস চক্রবর্তী ও আরটিও বোর্ডের সদস্য তথা তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি প্রদ্যোৎ ঘোষের।
অবশ্য, মুখ্যমন্ত্রীর এক নির্দেশেই কাজ কিছুটা এগিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে হকারেরা কী মেনে নেবেন? পুরপ্রধান বলেন, “সব রাস্তায় তো হকার নেই। ফুটপাথ তৈরির প্রয়োজনে যেখানে হকারদের কিছুটা সরে যেতে হবে।” সারা বাংলা হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক শঙ্কর দাস অবশ্য এতে রাজি নন। তাঁর কথায়, “এটা ছেলে খেলা নয়। এখন হকার নীতি হয়েছে। আমরাও চাই, শহরে ফুটপাত হোক, নিকাশী নালা হোক। কিন্তু সরকারী নীতি মেনে হকারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেই তা করতে হবে। না হলে আন্দোলন হবে।”
গোটা ব্যাপারটা যে সহজ নয়, তা বলছেন শহরের বহু মানুষ। কারণ, আগেও হকার উচ্ছেদ হয়েছে, রাস্তা খালি করা হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত পরিকল্পনার অভাবে ফের হকারে ভরে গিয়েছে রাস্তার দু’দিক। তৃণমূল ও পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, ফুটপাথ তৈরির সরকারি অনুমোদন মিললেই সব রাজনৈতিক দল ও হকারদের নিয়ে বৈঠক করা হবে। সেখানে নিশ্চয়ই সমাধান সূত্র বের হবে।