নজর নেই, অনাদরে ম্লান ঐতিহ্য

সুপ্রাচীন দণ্ডভুক্তিতে ইতিহাস মিশে আছে পুরনোর মাটির মতোই। মাটি খুঁড়ে তুলে আনা সে চিহ্ন বুকের উপর নিয়ে আজও বেঁচে দাঁতন। খ্রিস্টিয় সপ্তম শতকে গৌড়রাজ শশাঙ্কের আঞ্চলিক প্রশাসনিক কেন্দ্র, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আনাগোনা এই মাটিতেই।

Advertisement

দেবমাল্য বাগচী

দাঁতন শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:৫৩
Share:

চৈতন্যের স্মৃতি বিজড়িত দাঁতনের কাঁকড়াজিত মন্দির (বাঁ দিকে)। মোগলমারি বৌদ্ধ বিহার (ডান দিকে)।ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

সুপ্রাচীন দণ্ডভুক্তিতে ইতিহাস মিশে আছে পুরনোর মাটির মতোই। মাটি খুঁড়ে তুলে আনা সে চিহ্ন বুকের উপর নিয়ে আজও বেঁচে দাঁতন।

Advertisement

খ্রিস্টিয় সপ্তম শতকে গৌড়রাজ শশাঙ্কের আঞ্চলিক প্রশাসনিক কেন্দ্র, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আনাগোনা এই মাটিতেই। ষোড়শ শতকে এখানেই আবার মোগল-পাঠানের যুদ্ধ। দাঁতন শহরের নানা প্রান্তে ঐতিহ্য, ইতিহাস আর লোককথার আঁকিবুকি। বৌদ্ধগ্রন্থ ‘দাঠাবংশে’র বিবরণ অনুযায়ী, খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে বুদ্ধের একটি দাঁত এই স্থানে ছিল। তাই নাম হয়ে যায় দন্তপুর। এই দন্তপুরই আসলে দাঁতন।

মোগলমারি গ্রামে উদ্ধার হওয়া গুপ্ত পরবর্তী যুগের বৌদ্ধবিহার, লোককথার শরশঙ্কা দিঘি, মনোহরপুর রাজবাড়ি, কাঁকরাজিত চৈতন্য মন্দির— সবই আছে। তবু নেই দেখার মতো চোখ। শহরের চারদিকে থাকা এই জায়গাগুলিকে নিয়ে পর্যটন কেন্দ্র করার দাবি তুলেছেন দাঁতনের বাসিন্দারাই।

Advertisement

এক সময় দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার সহজ পথ ছিল দণ্ডভুক্তি বা দাঁতন। এখনও রয়েছে সেই পথ। নাম বদলে হয়েছে ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোড। সে পথেই যাতায়াত গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধভিক্ষুদের। দাঁতন শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে এখন যে খানে মনোহরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের মোগলমারি গ্রাম। লোকশ্রুতি অনুযায়ী ষোড়শ শতকে মোগল-পাঠানের যুদ্ধের সময়ে মোগলরা এই পথ (মাড়ি) দিয়ে গিয়েছিল। তাই নাম মোগলমারি। মোগলমারিতেই মিলেছে প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ। ২০০৩-০৪ সাল থেকে টানা ন’বছর ছ’দফায় উৎখনন চলেছে এখানে। উদ্ধার হয়েছে স্ট্যাকো মূর্তি, প্রবেশদ্বার, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থাকার জায়গা, বেশকিছু উৎসর্গ পাত্র, গুপ্ত উত্তর যুগের মিশ্র ধাতুর মুদ্রা-সহ বহু পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন।

ভূ-পর্যটক হিউয়েন সাঙ তাম্রলিপ্ত বন্দরে একাধিক বৌদ্ধবিহারের কথা বলেছিলেন। তার ভিত্তিতেই এই উৎখনন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক অশোক দত্ত মোগলমারি এলাকায় একটি উঁচু ঢিবি দেখে খনন শুরু করেন। ২০১৩ সালেও খনন চালিয়েছে রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগ। সে সময়ই এই বিহারের নাম ফলক হিসাবে পাওয়া গিয়েছে ‘শ্রী বন্দক মহাবিহার’।

কিন্তু গত বছরের মার্চ মাস থেকে বন্ধ হয়ে যায় খনন। চলতি বছরের শুরুতে অবশ্য মাস খানেক চলেছিল খননকাজ। স্ট্যাকো মূর্তির একটি অংশে ছাউনি দিয়েছে রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগ। উত্তর-পশ্চিম অংশেও বেশ কিছু অংশ সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সংগ্রহশালা গড়ে তোলা বা বৌদ্ধ বিহারে সাধারণ মানুষের যাতায়াত করার মতো ব্যবস্থা কিছুই করা হয়নি।

অভিযোগ এ রাজ্যের মানুষ ভিন্‌ রাজ্যে গিয়ে সাঁচী, সারনাথ দেখে আসছেন। অথচ তাঁরা জানেনই না তেমনটা রয়েছে এই পশ্চিম মেদিনীপুরেও। স্থানীয় বাসিন্দা ও একটি ক্লাবের উদ্যোগে সামান্য সামর্থে এখানেই তৈরি করা হয়েছে প্রদর্শনশালা। ওই ক্লাবের যুগ্ম-সম্পাদক অতনু প্রধান বলেন, “আমরা শুরু থেকে এই উৎখননের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। চাই এখানে দর্শনার্থী আসুক।’’ তাঁর দাবি এখনও সংরক্ষণের কাজ অনেক বাকি। সংগ্রহশালা হয়নি। তাই তাঁরা নিজেরাই সাধ্যমতো একটি প্রদর্শনশালা করেছেন। এই মোগলমারিকে কেন্দ্র করে একটি পর্যটন কেন্দ্র করা হলে এলাকার উন্নয়ন হবে বলে তাঁর মতো অন্য সব বাসিন্দারই দাবি।

শুধু মোগলমারির নয়। দাঁতনকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার মতো আরও বহু স্থান রয়েছে। মনোহরপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতেই রয়েছে প্রায় চারশো বছরের পুরনো রাজবাড়ি। এটি কিশোরচরণ রায় বিরবর বা তারও আগে কেউ নির্মাণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়। উত্তর রায়বাড়ে রাজার পুরনো একটি বাড়িতে এখনও দুর্গাপুজো হয়। সেখানে কালীচণ্ডীর হাট, মন্দির, পুকুর— সবই ছিল রাজার অধীন। রাজবাড়ির কাছেই যাত্রামঞ্চটিরও এখন ভগ্নপ্রায় দশা। উত্তরসূরি বিষ্ণুমঙ্গল রায় বিরবর বলেন, “আমরা বছর দু’য়েক আগে বাড়িটিকে হেরিটেজ ঘোষণা করার জন্য রাজ্যের কাছে আবেদন করেছিলাম। এখনও উত্তর পাইনি।’’

দাঁতনের পূর্বে রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ফুট দৈর্ঘ্য ও আড়াই হাজার ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট শরশঙ্কা দিঘি। লোকশ্রুতি অনুযায়ী গৌড়রাজ শশাঙ্কের আমলে এই দিঘি খনন করা হয়েছিল। যদিও এর কোনও লিখিত প্রমাণ আজও উদ্ধার হয়নি। আবার এমনও কথিত রয়েছে যে ১৪বছর বনবাসে ভীমের হাঁটুর আঘাতে এই দিঘির সৃষ্টি হয়েছে। লোকবিশ্বাসে অনেকেই মনে করেন এ দিঘির নীচে জমা আছে প্রচুর সম্পদ। প্রবীণ বাসিন্দারা সে সব গল্পের সঙ্গে মিল খুঁজে পান শশাঙ্কের রাজত্বের। তাই তাঁরা চান একটু মনোযোগ। নবতিপর জয়নারায়ণ মাইতি বলেন, ‘‘এই পুরাতাত্ত্বিক ক্ষেত্রের সংস্কার ও এলাকার উন্নয়ন চাই।” ২০১৪সালের মার্চে শুরু হয়েছে সংস্কার কাজ। দিঘির ধারেই রয়েছে একটি কালীমন্দিরও। স্থানীয় পুরোহিত প্রদীপ মিশ্র বলছিলেন, “এই দিঘির টানে মন্দিরে প্রতিদিন দর্শনার্থী আসেন। দিনে গড়ে ১০টি বিয়ে হয়। আমরা সকলে চাই এলাকায় দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে উপযুক্ত সড়ক নির্মাণ হোক।”

কাঁকরাজিত গ্রাম ঘিরেও নানা লোককথা জড়িয়ে রয়েছে। এখানে আনুমানিক ৩০০বছর আগে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল চৈতন্য মহাপ্রভু মন্দির। কথিত, নীলাচলে যাওয়ার পথে দীর্ঘদিন এই গ্রামে একটি বকুলগাছের তলায় ছিলেন চৈতন্য। এক ভক্ত প্রতিদিন তাঁকে নিয়ে বাড়ি-বাড়ি ভিক্ষা করে খেতেন। একদিন মহাপ্রভুকে খুঁজে না-পেয়ে ওইখানেই পুজো আরম্ভ করেন সেই ভক্ত। তার বহু বছর পরে এলাকার ভক্তরা এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দির কমিটির ম্যানেজার গণেশ চন্দও দাবি করেন এই মন্দিরের ভক্ত সমাগমের জন্য রাস্তার সংস্কার ও আলোর খুব প্রয়োজন।

তবে ইতিমধ্যে বামুনপুকুর থেকে কাঁকরাজিত হয়ে শালিকোটা যাওয়ার ৭ কিলোমিটার সড়ক পথের সংস্কারের অনুমোদন হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এ ছাড়াও দাঁতনে শ্যামলেশ্বর মন্দির, বিদ্যাধরপুকুর, চন্দনেশ্বর মন্দিরের মতো একাধিক দর্শনীয় স্থান রয়েছে।

সব মিলিয়ে পর্যটক টানার মতো এমন প্রাচীন শহরে এখনও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব রয়ে গিয়েছে। সংস্কারের অভাবে ধুঁকছে অধিকাংশ সড়ক। তাই এলাকাবাসীর দাবি এলাকায় পর্যটক টানতে উন্নত পরিকাঠামো গড়ে পর্যটন কেন্দ্র করা হোক। এলাকার বিধায়ক বিরাম মাণ্ডি বলেন, ‘‘আমি পর্যটন দফতরে আগেও বলেছি আবারও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য বলব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন