প্রেম-পাঠে জড়তা কাটাচ্ছে শিল্পশহর

রক্ষণশীলতা কাটিয়ে প্রেমে সাবালক হচ্ছে হলদিয়া। বছর কুড়ি আগেও বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য ছুতো খুঁজতে হত। মোবাইলের রমরমা না থাকায় যোগাযোগের জন্য চিঠিই ছিল একমাত্র ভরসা।

Advertisement

সামসুদ্দিন বিশ্বাস

হলদিয়া শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:২০
Share:

সিটি সেন্টারে নিশ্চিন্তেই কেনাকাটা সারলেন প্রেমিক-প্রেমিকারা। ছবি: আরিফ ইকবাল খান।

রক্ষণশীলতা কাটিয়ে প্রেমে সাবালক হচ্ছে হলদিয়া।

Advertisement

বছর কুড়ি আগেও বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য ছুতো খুঁজতে হত। মোবাইলের রমরমা না থাকায় যোগাযোগের জন্য চিঠিই ছিল একমাত্র ভরসা। আই প্যাড, ইন্টারনেটের যুগে প্রেমে এখন অনেক পরিণত নবীন প্রজন্ম। বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হলেই মোবাইল ছাড়াও হাতের কাছেই রয়েছে বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট। ‘টেকস্যাভি’ টিনএজারদের কাছে তাই প্রেমের জন্য দরকার নেই কোনও ছুতো। ভয় নেই বাবামার কাছে বকুনি খাওয়ারও।

ভ্যালেন্টাইনস্ ডে-এর আগে ঊনিশ-কুড়ির দামাল তরুণদের উন্মাদনাকে খানিকটা ঈর্ষার চোখেই দেখছেন প্রবীণ গৌতম কুণ্ডু। তাঁর আক্ষেপ, “বছর চারেকের প্রেমের জীবনে বড়জোর ৪০ দিন প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছি। সিনেমা দেখার সুযোগ মিলেছিল মেরেকেটে এক দিন। ভাবা যায়!” “বান্ধবীর সঙ্গে ঘুরতে বেরলে উপরি পাওনা ছিল ভয়। রাস্তায় যদিও কেউ দেখে ফেলে। তাহলে তো আর বাড়ি ফিরলে বাবা আস্ত রাখবে না। তাই চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতে হত।” বলে চলেন তিনি। সেই সময় স্কুল-কলেজে যাওয়ার পথেই তাই মনটা উদাস হয়ে যেত প্রেমিক-প্রেমিকার। যদি পথে একবার তার দেখা মেলে, মন্দ হয় না।

Advertisement

বছর আটচল্লিশের সমীর মহাপাত্র হলদিয়ার বৈষ্ণবচকের বাসিন্দা। ভালবাসার দিনের আগে তাঁরও মনে উঁকি মারছে পুরনো সেই দিনের কথা। কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়েই তিনি বলে চলেন, “প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে গেলে ভয়ই লাগত। এখন সেই ভয় অনেকটা কেটেছে। এখন তো শুধু স্কুল-কলেজ নয়, শপিং মল, পার্কে যখন খুশি তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা দেখা করতে পারে।” শহরের প্রবীণ বাসিন্দাদের মতে, ভ্যালেন্টাইনস্ ডে নিয়ে এই উন্মাদনা আগে ছিল না। তখন বন্ধু বা বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করাও এত সহজ ছিল না। তাই একবার সুযোগ পেলেই মনে হত হাতে স্বর্গ এসে গিয়েছে। বছর দশেক আগেও শহরে বিনোদনের জায়গা তেমন ছিল না। মাল্টিপ্লেক্স বা শপিং মল তো দূর অস্ত! তাই প্রেমের জায়গা বলতে হলদি নদীর ধার বা সতীশ সামন্ত পার্কই ছিল ভরসা। হলদি নদীর ধারেই তখন একটুকরো বসার জায়গা পেতে কালঘাম ছুটত। “স্কুলে টিফিনের সময় প্রেমিকের সঙ্গে সামান্য চোখাচোখি অথবা সুযোগ পেলে সামান্য কথা হত। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কখনও চলে যেতাম হলদি নদীর ধারে একটু আড্ডা মারতে। ব্যস ওইটুকুই ছিল আমাদের আনন্দ। এখন তো আবার ভ্যালেন্টাইনস্ ডে হয়েছে। আরে বাবা প্রেম নিবেদন করতে গেলে কার্ড, শো-পিস লাগে নাকি, একটা গোলাপই যথেষ্ট।” বক্তব্য সঞ্জীবকুমার প্রামাণিকের।

বর্তমানে শহরে অনেক নতুন বিনোদনের স্থান গড়ে উঠেছে। গত বছর দুর্গা পুজোর আগে শহরে গড়ে উঠেছে সিটি সেন্টার। তাই হুগলি-হলদি নদীর পাড় ছেড়ে নবীন প্রজন্ম এখন অনেক বেশি শপিং মলমুখী। সঙ্গে হাতিবেড়িয়ার সতীশ সামন্ত পার্ক, হলদিয়া পুরসভার সামনে ভাষা উদ্যান-সহ বিভিন্ন পার্ক তো আছেই। স্কুল-কলেজ বা টিউশনের পর সময় বের করে মনের কথা বলতে দলে দলে যুবক-যুবতীরা ভিড় জমাচ্ছেন মাল্টিপ্লেক্সে। কলেজ পড়ুয়াদের মতে, শপিং মলে অনেকক্ষণ নিখাড আড্ডা মারা যায়। ইচ্ছে হলে পছন্দের খাবারও পাওয়া যায়। হলদিয়ার বিষ্ণুরামচকের বাসিন্দা দেবাশিস দাসের কথায়, “আগে সময় পেলেই সতীশ সামন্ত পার্কে বা নদীর ধারে আড্ডা মারা যেত। এখন অবশ্য শহরে সিটি সেন্টার মল চালু হয়েছে। যেখানে প্রেমিকাকে নিয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়া যায়। তাছাড়া প্রয়োজনে বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট তো আছেই।” ২০০৮ সাল থেকে প্রেম করছেন মহিষাদলের গৌরিশঙ্কর পাল। ২০১১ সালে তিন বছরের প্রেম পর্ব শেষে বিয়ে। তাঁর কথায়, “আগে শুধু টেলিফোনেই প্রেমিকার সঙ্গে কথা হত। মাঝে-মধ্যে স্কুলে গিয়েও দেখা হত।”

ভ্যালেনটাইনস্ ডের আগের দিন শুক্রবার দিনভর শহরের বিভিন্ন উপহারের দোকানে ছিল যুবক-যুবতীদের ভিড়। শহরের এক যুবকের মতে, উপহার যতই দামি হোক না কেন। একটা গোলাপ না থাকলে সবটাই কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে লাগে। তাই গোলাপ দোকানগুলিতেও ছিল উপচে পড়া ভিড়। হলদিয়া টাউনশিপের ফুল ব্যবসায়ী সাগর মাইতি জানান, ভ্যালেন্টাইনস্ ডে উপলক্ষে এক সপ্তাহ আগে থেকে ফুলের অর্ডার আসতে শুরু করেছে। অর্ডারের চাপ থাকায় বেঙ্গালুরু থেকে ১২টি রঙের ১২ হাজার গোলাপ আনাচ্ছি। শুক্রবারই ফুল এসে যাবে।

গোলাপের দাম কেমন? উত্তরে তিনি বলেন, “অন্য বছর বেঙ্গালুরুর ওই প্রজাতির একটি গোলাপ ২০ টাকা করে বিক্রি হয়। এ বার অবশ্য দাম বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে। তবে গোলাপ ছাড়াও ‘ওরিয়েন্টাল লিলিস’, ‘আন্থেরিয়াম’ ফুলের অর্ডারও পেয়েছি। সারা বাংলা ফুল চাষি ও ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নারায়ণ নায়ক বলেন, “১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস্ ডে-এর পাশাপাশি বিয়ের মরসুমও পড়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ফুলের দাম বেড়েছে। বছরের অন্য সময় ইতালিয়ান প্রজাতির ১০০টি গোলাপ ফুল ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হত। কিন্তু এ সময় তার দাম বেড়ে ৪০০ টাকা হয়েছে।”

তবে দাম যতই হোক, থোড়াই কেয়ার। ভালবাসার দিনে মনের মানুষকে সবচেয়ে ভাল উপহার দিতে প্রস্তুত হচ্ছে যুবক-যুবতীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন