প্রথম জাতীয় সরকার হয়েছিল খেজুরিতেই

বিদ্রোহ, প্রতিবাদ আর আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান খেজুরি। জন্মলগ্ন থেকেই বিদ্রোহ আর আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বারবার শিরোনামে উঠে এসেছে মেদিনীপুরের সমুদ্র উপকূলবর্তী খেজুরি। ১৮০৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত মলঙ্গিদের (নুন শ্রমিক) বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে খেজুরির যে সংগ্রামী আন্দোলনের সূচনা, পরবর্তীকালে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, বিলেতি বর্জন, লবণ সত্যাগ্রহ, অগস্ট বিপ্লব বা ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী তেভাগা আন্দোলন ও জমিদারি প্রথা বিলোপ ও তেভাগা আন্দোলনে বার বার শিরোনামে উঠে এসেছে খেজুরির জন্মসিদ্ধ প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী মনোভাব।

Advertisement

সুব্রত গুহ

খেজুরি শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৫ ০১:১১
Share:

দেশের প্রথম জাতীয় বিদ্যালয় কলাগেছিয়া জগদীশচন্দ্র বিদ্যালয়। ছবি: সোহম গুহ।

বিদ্রোহ, প্রতিবাদ আর আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান খেজুরি। জন্মলগ্ন থেকেই বিদ্রোহ আর আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বারবার শিরোনামে উঠে এসেছে মেদিনীপুরের সমুদ্র উপকূলবর্তী খেজুরি। ১৮০৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত মলঙ্গিদের (নুন শ্রমিক) বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে খেজুরির যে সংগ্রামী আন্দোলনের সূচনা, পরবর্তীকালে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, বিলেতি বর্জন, লবণ সত্যাগ্রহ, অগস্ট বিপ্লব বা ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী তেভাগা আন্দোলন ও জমিদারি প্রথা বিলোপ ও তেভাগা আন্দোলনে বার বার শিরোনামে উঠে এসেছে খেজুরির জন্মসিদ্ধ প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী মনোভাব। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও খেজুরির ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। স্বাধীনতা আন্দোলনে খেজুরির অগ্রণী ভূমিকায় খেজুরিকে ‘বাংলার হলদিঘাট’ বলে অভিহিত করেছিলেন চারণকবি মুকুন্দ দাস।

Advertisement

১৯২১ সালে খেজুরির কলাগেছিয়ায় অখণ্ড বঙ্গদেশের প্রথম ‘জাতীয় বিদ্যালয়’ স্থাপন করা ছাড়াও ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে খেজুরিতেই থানা দখল করে হয়েছিল দেশের প্রথম জাতীয় সরকার। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের আগে টানা তিন মাস ‘মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র’ সিলমোহর দিয়ে সেই জাতীয় সরকার দ্বারা স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়েছিল খেজুরি। স্বাধীনতা আন্দোলনে খেজুরিতে ক্ষুদিরাম বসু, জাতির জনক মহাত্মা গাঁধী, সুভাষচন্দ্র বসুর খেজুরিতে আগমন ছাড়াও স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রসারিত করতে খেজুরিতে এসেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়, চারণকবি মুকুন্দ দাস।

খেজুরি আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক প্রবালকন্তির হাজরার ‘নিমক মহালের মলঙ্গি বিদ্রোহ’ প্রবন্ধ বলছে, ১৮০৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে কোম্পানির লবণ শ্রমিকদের নায্য মজুরি আর কাজের সময় কমানোর দাবিতে দশ হাজারের বেশী লবণ শ্রমিক কোম্পানির বিরুদ্ধে খেজুরির মাটিতে প্রথম বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন। ইতিহাসে যা ‘মলঙ্গী বিদ্রোহ’ বলে পরিচিত। ১৭৬৫ সালে বাংলা বিহার ওড়িশার দেওয়ানি লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘সোসাইটি অব ট্রেড’ গঠন করে তৎকালীন নিমক মহাল বলে চিহ্নিত ও পরিচিত খেজুরি, হিজলি, নন্দীগ্রাম, বীরকুল, তমলুক ও মহিষাদলের উপকূল জুড়ে নিমক মহালে একচেটিয়া লবণ তৈরি ও বিক্রির কারবার শুরু করেছিল। লবণ তৈরির জন্য নিযুক্ত করা হয় স্থানীয়দের। লবণ তৈরির কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের মলঙ্গি বলা হত। মলঙ্গি কথার অর্থ ময়লা, নোংরা ও কৃষ্ণবর্ণ। বিদেশি বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লবণ কারবারে আরও বেশী করে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে মলঙ্গিদের দিয়ে অত্যাধিক কাজ করানো ছাড়াও কম পারিশ্রমিক দিয়ে অবিচার ও অত্যাচার আর অমানুষিক শোষণ শুরু করে। এই শোষণের প্রতিবাদে মলঙ্গিরা জোটবদ্ধ হয়ে ১৮০৪ সালে কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেছিলেন।

Advertisement

খেজুরির প্রবীণ সাংবাদিক ও সাপ্তাহিক ‘খেজুরি’ পত্রিকার সম্পাদক পার্থসারথি দাসের লেখা ‘খেজুরির স্বাধীনতা সংগ্রাম’ প্রবন্ধ সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গ নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের মধ্য দিয়েই খেজুরিতে সর্বপ্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের সুত্রপ্রাত হয়। সেই সময় খেজুরির হেঁড়িয়া থানার অধীন জুখিয়া আর ঠাকুরনগর আর ভগবানপুর থানার মুগবেড়িয়াতে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর সেই সময় অনুশীলনী সমিতির হয়ে নিয়মিত যাতায়াত ছাড়াও কুস্তির আখড়া তৈরি করে ছোরা ও লাঠিখেলার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বদেশী যুবকদের অনুশীলনী সমিতির হয়ে মাতৃভূমির মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত করার কাজে ব্রতী ছিলেন।

‘স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর’ বইয়ের লেখক ও মুগবেড়িয়া কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ হরিপদ মাইতির লেখায় জানা যায়, ১৯২১ সালে খেজুরির কলাগেছিয়াতে স্থাপিত হয়েছিল বঙ্গদেশের প্রথম জাতীয় বিদ্যালয়। ১৯২১ সালে গাঁধীজির বিদেশি বর্জন আন্দোলনে উত্তাল খেজুরিতে ব্রিটিশ অনুমোদিত স্কুল ছেড়ে দলে দলে বেরিয়ে এসেছিল ছাত্রছাত্রীরা। সরকারি স্কুলের চাকরি ছেড়ে নিকুঞ্জ মাইতি ও আইন ব্যবসা ছেড়ে দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল সেই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। খেজুরির কলাগেছিয়া গ্রামের জমিদার জগদীশচন্দ্র মাইতির উদ্যোগে ১৮৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত কলাগেছিয়া মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল উদ্বোধন করলেন দেশের প্রথম জাতীয় বিদ্যালয়ের। জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক হলেন বিপ্লবী নিকুঞ্জবিহারী মাইতি।

১৯৪৬ সালের ৩ জানুয়ারি খেজুরিতে ব্রিটিশ পুলিশের দমন পীড়নে অত্যাচারিত খেজুরিবাসীর দুর্দশা স্বচক্ষে দেখতে গাঁধীজি হিজলি টাইডাল ক্যানেল ধরে জলপথে নৌকা যোগে খেজুরির কৃষ্ণনগরে এসেছিলেন। জরারনগরের জনসভায় সুভাষচন্দ্রের উত্তোলিত জাতীয় পতাকা ও খেজুরি কৃষ্ণনগরে এসে গাঁধীজীর উপবেশন করা আসন আজও সুভাষ শিল্প ভারতীর সংগ্রহালয়ে সংরক্ষিত রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন