বাতিস্তম্ভ মনে করায় বাণিজ্যের ইতিহাস

একসময় সমুদ্রতীরের বাতিস্তম্ভের আলো পথ দেখাত এগরায় আসা বাণিজ্যতরীকে। বর্তমান এগরা শহরের ২-৩ কিলোমিটার দক্ষিণে কুডিতে মুক্তেশ্বর মন্দিরের পাশে আজও সেই বাতিস্তম্ভের অস্তিত্ব রয়েছে। যদিও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ওই বাতিস্তম্ভ আজ ভগ্নপ্রায়। জনশ্রুতি, আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে সমুদ্রের জল ঢেউ খেলত এগরার কোলে। জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের কলরবে তখন মুখরিত হত উপকূলবর্তী এলাকা। সমুদ্রের ধারেই বসত বাজার। এগরা নামের উৎপত্তি অগরাপত্তনম থেকে।

Advertisement

কৌশিক মিশ্র

এগরা শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:৩৯
Share:

এগরার প্রাচীন হট্টনাগর মন্দির।—নিজস্ব চিত্র।

একসময় সমুদ্রতীরের বাতিস্তম্ভের আলো পথ দেখাত এগরায় আসা বাণিজ্যতরীকে। বর্তমান এগরা শহরের ২-৩ কিলোমিটার দক্ষিণে কুডিতে মুক্তেশ্বর মন্দিরের পাশে আজও সেই বাতিস্তম্ভের অস্তিত্ব রয়েছে। যদিও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ওই বাতিস্তম্ভ আজ ভগ্নপ্রায়। জনশ্রুতি, আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে সমুদ্রের জল ঢেউ খেলত এগরার কোলে। জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের কলরবে তখন মুখরিত হত উপকূলবর্তী এলাকা। সমুদ্রের ধারেই বসত বাজার। এগরা নামের উৎপত্তি অগরাপত্তনম থেকে। অগরাপত্তনমের অর্থও বাজার। জেলার অন্যতম সমৃদ্ধ এই বাজারে তখন জেলার নানা প্রান্ত থেকে লোকও আসত। এগরা থেকে মূলত লবণ, বিভিন্ন শস্য ও মৎস্যের বাণিজ্য হত বলে জানা যায়। কথিত আছে, পরবর্তী কালে বালিতে ভরাট হয়ে সমুদ্র ক্রমশ পিছু হঠে। বদলে যায় এগরার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার ধারাও।

Advertisement

এগরা আগে ওড়িশার অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রবীণ ইতিহাসবিদদের মতে, ১৫৬০-১৫৬৪ সালের মধ্যে ওড়িশার গঙ্গো বংশীয় রাজা মুকুন্দদেবের আমলে এগরার সামন্ত রাজা দিব্যসুন্দর করমহাপাত্রের সহযোগিতায় সমুদ্র উপকুলে পুরী মন্দিরের স্থাপত্যের অনুকরণে হট্টনাগর শিবমন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়। পশ্চিমমুখী মূল মন্দিরের প্রধান অংশ গর্ভগৃহে ভূমি থেকে ১৭ ফুট নিচে রয়েছে শিবলিঙ্গ। এরপর জগমোহন ও বিষ্ণু মন্দির।

একদা শিবরাত্রি উপলক্ষে মন্দির প্রাঙ্গণে বসত জমজমাট মেলার আসর। ইংরেজ ঐতিহাসিক এল এস এস ও মোলি সাহেবও তাঁর গ্রন্থে এই মেলার নাম উল্লেখ করেছেন। এগরা মেলা শুরু হওয়ার পর থেকে এই মেলা তার জৌলুস হারিয়েছে। বাসিন্দাদের মতে, এগরা মেলাই শহরের সংস্কৃতিকে বহন করে চলেছে। ১৯৮৭ সালে এগরা মেলার সূচনা হয়। মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ডের সম্পাদক স্বপনকর মহাপাত্র বলেন, “আগের চেয়ে মন্দিরের কৌলীন্য অনেক কমে গিয়েছে। মন্দিরটির আশু রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন।” তবে সরকারি সাহায্যের বিষয়ে তাঁর আক্ষেপ, “সরকার অধিগৃহীত মন্দিরগুলির অবস্থা দেখে এটা বুঝেছি, কোনওমতেই মন্দিরটিকে সরকারের হাতে তুলে দিতে রাজি নই। আমরাই যতটা সম্ভব মন্দিরটির ঐতিহ্য রক্ষার চেষ্টা করব।”

Advertisement

বছর পাঁচেক আগে এগরার পাঁচরোল থেকে একটি তাম্রফলক উদ্ধার হয়। ফলকটিতে ৬০১-৬২৫ খিস্টাব্দ পর্যন্ত এগরায় গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের শাসনকার্যের বিবরণ পাওয়া যায়। মেদিনীপুরের ইতিহাস গ্রন্থে ৩০০ বছরেরও বেশি পুরনো বাসন্তীতলা সংলগ্ন কালীমন্দিরের কথা উল্লেখ আছে। এগরা পুর এলাকার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের তাহালিয়া মসজিদটিও প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো। এগরার মাটি সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায়েরও স্মৃতি বিজড়িত। ১৮৬০ সাল থেকে প্রায় এগারো মাস তিনি নেগুয়া মহকুমার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে এগরার পুরভবন সংলগ্ন ডাকবাংলোতে তাঁর অফিস ছিল বলে জানা যায়। ডাকবাংলো সংলগ্ন আমতলায় বসে তিনি বহু বইও লিখেছেন। যদিও সেই আমতলা আজ অবলুপ্ত। ডাকবাংলোর একটা অংশ বর্তমানে সেচ দফতরের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে মূল ভবনটির জীর্ণ দশা। ভবনের দরজা-জানালা বেয়ে গজিয়ে উঠেছে আগাছা। এগরা কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক মনোরঞ্জন মিশ্রের কথায়, “প্রায় দশ মাসের বেশি সময় বঙ্কিমচন্দ্র এখানে থাকলেও তাঁর স্মৃতি বিজড়িত ডাক বাংলো সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থাও করা হয়নি।” যদিও এগরার মহকুমাশাসক অসীমকুমার বিশ্বাসের বক্তব্য, “এখানে দায়িত্ব নিয়ে আসার পর কেউ শহরের প্রাচীন ঐতিহ্যের সংরক্ষণ নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেননি। বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই সরকারি স্তরে আলোচনা করে কিছু করার চেষ্টা করব।”

এগরার দুই হাইস্কুলের মাঝের কৃষ্ণসাগরের ইতিহাসও বেশ প্রাচীন। ইতিহাস গবেষক শান্তিপদ নন্দ বলেন, “পটাশপুর ধুসুরদাগড়ের চৌধুরী কৃষ্ণচন্দ্র মিত্র স্থানীয় বাসিন্দাদের জলকষ্টের সমস্যা সমাধানের জন্য এই পুকুরের খনন কাজ চালান।” ১৯০২ সালে ক্ষুদিরাম এগরায় এসে ওই সাগরেই স্নান করে গোপনে পুকুর পাড়ের কুটীরে স্বদেশীদের নিয়ে বৈঠক সেরেছিলেন বলে জনশ্রুতি।

এগরা সাধারণ পাঠাগারকে বাদ দিয়ে শহরের ঐতিহ্য অসম্পূর্ণ। পাঠাগারের বর্তমান গ্রন্থাগারিক কানাইলাল দাস জানান, আগেকার সুবোধ গ্রন্থাগারই পরে এগরা সাধারণ গ্রন্থাগার রূপে আত্মপ্রকাশ করে। যোগেন্দ্রনাথ মাইতির তত্ত্বাবধানে ১৯৫৮ সালে সাহিত্যচর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে সাধারণ পাঠাগারটি বিশেষ স্থান অধিকার করে। গ্রন্থাগারিকের দাবি, এক বছরে গ্রন্থাগারের প্রায় ৩০ শতাংশ পাঠক কমে গিয়েছে। কারণ হিসেবে কর্মী সঙ্কট, স্থানীয় বাসিন্দাদের সংস্কৃতি সচেতনতার অভাব দায়ী।

শহরবাসীর আক্ষেপ, ১৯৯৩ সালে এগরা পুরসভা গঠিত হয়েছে। তারপর পেরিয়ে গিয়েছে ২১টা বছর। তবুও গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে শহর হয়ে ওঠার পথে এক কদমও এগোয়নি এগরা। ১৪টি ওয়ার্ড বিশিষ্ট পুর শহরের অধিকাংশ বাড়িতে নেই পানীয় জলের ব্যবস্থা। নামে শহর হলেও এলাকার ৭০ শতাংশ বাসিন্দাই কৃষিজীবী। নেই পর্যাপ্ত সেচের ব্যবস্থা। বেশিরভাগ রাস্তা বেহাল হওয়ায় বছরভর নাকাল হন শহরবাসীরা। এগরা পুরসভায় প্রাক্তন পুরপ্রধান স্বপন নায়ক বলেন, “এগরা শহরের আয়তন খুব কম। উন্নত পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা প্রয়োজন। অর্থও তেমন আসেনি। তবে আমার সময়ে আমি কিছু কাজ করবার চেষ্টা করেছি।” এ বিষয়ে মহকুমাশাসকের ব্যাখ্যা, “পুরসভা হিসেবে এগরার আরও উন্নতি হওয়া উচিত ছিল। যে ভাবেই হোক তা হয়ে ওঠেনি। প্রশাসনিক স্তরে এ বিষয়ে আলোচনা করব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন