বেলদার দিঘা মোড়ে যাত্রার পোস্টার।
রকমারি আলো-বাদ্যযন্ত্র, ঝকমকে সাজপোশাক, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি চিত্রনাট্য রয়েছে সবই, তবুও প্রতিযোগিতায় পিছোচ্ছে যাত্রাপালা। রাজ্যের গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্তর্গত এই আঞ্চলিক শিল্প হাল আমলের টেলিভিশনের ‘সিরিয়াল’-এর জনপ্রিয়তায় যথেষ্টই কোণঠাসা। তা মানছেন পরিচালক-প্রযোজকরাই। একই ছবি পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদার যাত্রাশিল্পের ক্ষেত্রেও।
কেমন? বেলদার প্রবীণ পরিচালক যুগলকিশোর দে-র কথায়, বছর পনেরো আগেও ৫০-৫৫টি দল ছিল এলাকায়। এখন কমে দাঁড়িয়েছে ২০-২৫টিতে। টাকা না ওঠায় প্রযোজকরা পিছিয়ে যাচ্ছেন। আর প্রযোজক রকিবুল শাহ বলছেন, “এখন সিরিয়ালের অভিনেত্রীদের প্রতি আমজনতার আকর্ষণ এতটাই বেড়েছে যে, দল চালানোই দায়। আগে বছরে দু’শো তো বটেই, আড়াইশো দিনও অভিনয় হত। এখন একশো দিন করতে হিমশিম! চালাবো কী করে?”
‘কিষ্ট যাত্রা’ দিয়ে শুরু হয়েছিল বেলদার যাত্রা-অভিযান। সে বহু যুগ আগের কথা। গরুর গাড়িতে শিল্পীরা যেতেন। সূর্য ওঠার আগেই হ্যাজাক, বাঁশি, তবলা, সঙ্গে বাবুর্চি, রান্নার সরঞ্জাম নিয়ে শিল্পীরা বেরিয়ে পড়তেন গরুর গাড়িতে। ভর দুপুরে কোনও পুকুর ধারে গাছের ছায়ায় রান্না করে দুপুরের খাওয়া। সন্ধের আগেই যে পৌঁছতে হবে প্রত্যন্ত কোনও গাঁয়ে। ছিল না মাইক, রকমারি আলো। চিত্কার করে শোনাতে হত সংলাপ। গানও গাইতে হত নিজেদেরই, তাতেও হাততালির বন্যা বইত। বছরে দু’আড়াইশো রাত যাত্রা করতে পারত বেলদার প্রতিটি দলই। যাত্রার আঁতুড়ঘর কলকাতার চিত্পুরের নাম কে না জানে। তবে, বেলদাও কম নয়। এখন অবশ্য পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমারেও বেশ ভাল কিছু যাত্রাদল রয়েছে।
তবুও যাত্রা শিল্পকে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে দেওয়া, অক্ষরহীন প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিল্পী হিসাবে মানুষের কাছে তুলে ধরা, যাত্রাকে আঁকড়ে ধরে বহু পরিবারের দু’বেলা অন্নের সংস্থান করে দেওয়ার ক্ষেত্রে বেলদার কৃতিত্বকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। একটা সময় ছিল, যখন ভিডিও, হাঙ্গামা-র মতো অশ্লীল নাচ এই শিল্পকে চরম ধাক্কা দিয়েছিল। তখনও প্রবল লড়ে অস্তিত্ব টিকিয়েছিল যাত্রা। কিন্ত, এখন সেই লড়াই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে।
এখন দল চালাতে প্রধান সমস্যাগুলি কী? বেলদার যাত্রাদলগুলির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই ধরনের যাত্রা টিকিট কেটে বড় কেউ দেখতে আসেন না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিখরচায় তা দেখানোর ব্যবস্থা করেন কর্মকর্তারা। এক রাতের পালার জন্য ব্যয় হয় ২০-২২ হাজার টাকা। কিন্তু, এখন ওই পরিমাণ টাকা খরচ করতে অধিকাংশ সময়েই রাজি থাকে না কমিটিগুলি। পরিবর্তে, ৫০ হাজার বা এক লাখ টাকা দিয়ে সিরিয়ালের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে আসেন। তাতে ভিড় হয় বেশি। কমিটির নাম মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু যাত্রার বেলায় তা হয় না।
চলছে যাত্রা দলের মহড়া।
আরও কিছু সমস্যা রয়েছে। যেমন, অনেক ক্ষেত্রে কমিটিগুলি অল্প টাকায় বায়না করে। কিছু প্রযোজকের বক্তব্য, অভিনয় শেষে কিছু কমিটির নানা বাহানা! ভৃত্যের ‘রোল’ ঠিক হয়নি। চাকর কী ও ভাবে চলাফেরা করে? নায়িকা একটু ছোট্ট পোশাক পরে একটাও নাচল না! অভিযোগ, এমনই নানা অছিলায় টাকা কমানোর চেষ্টা করে কিছু কমিটি।
মূলত, পুজোর মরসুমেই এই সব যাত্রাপালা হয় গ্রামেগঞ্জে। সে ক্ষেত্রে যাত্রার গাড়ি দেখলেই চাঁদার জুলুম শুরু হয়। এমনই নানা ঝক্কি নিয়ে দল চালানো ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন বেলদা যাত্রা সংসদের সভাপতি দিলীপ দাস। তিনি বলেন, “প্রতিনিয়ত এমন অভিযোগ আসতেই থাকে। আমরা বসে মীমাংসা করে টাকা আদায় করার চেষ্টা করি। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যা হয়।” এমনই নানা কারণে যাত্রা শিল্পে মন্দার বহর বাড়ছেই।
শিল্পে মন্দা চললে শিল্পীদের ভবিষ্যত্ যে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধরা যাক দিলীপ পাল, কবিতা পালের কথা। নাবালক অবস্থা থেকেই ওঁরা অভিনয় করেন। যাত্রা করতে করতেই ভালোবাসা এবং বিয়ে। তাঁদের কথায়, “আগের থেকে টাকা বাড়লেও, খরচ বেড়েছে অনেক বেশি। সাধারণ মানুষ যাত্রা দেখতে না চাইলে কী ভাবে বেশি টাকা দাবি করব! আমাদের দুর্দশা যে কবে কাটবে!”
বেলদার প্রিয়াঙ্কা রাউত্, বিষ্ণুপদ পরিয়ারী, প্রকাশ চট্টোপাধ্যায়দের মতো শিল্পীরা বলছেন, “আগে যে কোনও অনুষ্ঠানেই যাত্রা হত। এখন সেখানে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে কিংবা অর্কেস্ট্রার মতো অনুষ্ঠান হচ্ছে। ফলে আমাদের ভবিষ্যত্ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।” আগে ছিল পৌরাণিক পালা, ঐতিহাসিক পালা। সে দিন গিয়েছে। শিল্পের অন্য মাধ্যমগুলির সঙ্গে তাল মেলাতে একটু ছোট্ট পোশাক, নাচ, গান, প্রেম-ভালবাসা আমদানি করেছেন পরিচালকেরা। খরচ বাড়লেও কিছু ক্ষেত্রে সিরিয়ালের অভিনেত্রীদের দিয়ে যাত্রা করিয়েছেন। তবে ‘সাবিত্রী সত্যবান’, ‘জেল থেকে বলছি’, ‘রথের মেলায় মা কিনেছি’, ‘বাগদি বাড়ির বৌ’ ছেড়ে ‘আমি ম্যাডাম নম্বর ওয়ান’, ‘সংসার স্টেশনে বৌমা এক্সপ্রেস’ ছুটিয়েও, যেন এঁটে উঠতে পারছে না দলগুলি।
অথচ, এক সময় এই বেলদা থেকেই অভিনয় করে কলকাতায় গিয়ে যাত্রা জগতে তারকা হয়েছেন রাঙা মিশ্র, বিদিশা মহান্তি, বিপাশা মহান্তির মতো শিল্পীরা। এ কথা বলায় সময়ে শিল্পী, প্রযোজকরা গর্ব অনুভব করেন। সেই আত্মবিশ্বাস থেকেই তাঁরা ফের লড়াইয়ের কথা বলেন। তাতেই আস্থা রাখছেন বেলদা-সহ রাজ্যের শিল্পীই। বায়নার জন্য অফিস খুলে বসা, বিভিন্ন যাত্রাপালার পোস্টার ঝুলিয়ে রাখা, প্রযোজকদের উত্সাহ দেওয়া চলছেই।
সুদিন কি ফিরবে? উত্তর এখনও অজানাই।
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
কেমন লাগছে আমার শহর? আপনার নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-বেলদা’। অথবা চিঠি পাঠান,
‘আমার শহর’, মেদিনীপুর বিভাগ, জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১