রাস্তায় গাড়ি আটকে চাঁদার জুলুম চলছেই

ভগবানপুর এলাকায় সড়ক পরিদর্শনে গিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে চাঁদা আদায়কারীদের মুখে পড়েছিলেন খোদ পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক অন্তরা আচার্য। জেলাশাসকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মীদের তৎপরতায় হাতেনাতে ধরা পড়েন পাঁচ চাঁদা আদায়কারী। এ বার হলদিয়া-মেচেদা ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কে চাঁদার জুলুমের শিকার হলেন এক ট্রাক চালক ও তাঁর দুই সহকর্মী।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

তমলুক শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৪ ০০:২৫
Share:

রাস্তার উপর মোটরচালিত ভ্যান, গাড়ি আটকে চলছে চাঁদার জুলুম। তমলুক-শ্রীরামপুর রাস্তার সাওতানচকে। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

ভগবানপুর এলাকায় সড়ক পরিদর্শনে গিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে চাঁদা আদায়কারীদের মুখে পড়েছিলেন খোদ পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক অন্তরা আচার্য। জেলাশাসকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মীদের তৎপরতায় হাতেনাতে ধরা পড়েন পাঁচ চাঁদা আদায়কারী। এ বার হলদিয়া-মেচেদা ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কে চাঁদার জুলুমের শিকার হলেন এক ট্রাক চালক ও তাঁর দুই সহকর্মী। শুক্রবার সকালে মহিষাদলের কাপাসএড়িয়ার কাছে হলদিয়া-মেচেদা ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কে চাঁদা আদায়ের জেরে হলদিয়াগামী দু’টি ট্রাকের মধ্যে ধাক্কা লাগে। ওই ঘটনায় একটি ট্রাকের চালক সুকেশকুমার যাদব গুরুতর আহত হন। তাঁকে তমলুক জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাঁকে কলকাতায় স্থানান্তর করা হয়েছে। ওই আহত ট্রাক চালকের সহ-কর্মীদের অভিযোগ, এ দিন সকালে কাপাসএড়িয়ার কাছে স্থানীয় একটি কালীপুজো কমিটি সড়কে গাড়ি আটকে চাঁদা তুলছিল। এভাবে চাঁদা তোলার জন্য আচমকা একটি গাড়ি দাঁড় করানোর ফলে সুকেশের গাড়ি সামনের দিকে থাকা একটি লরির পিছন দিক থেকে ধাক্কা মারে। ওই দুর্ঘটনায় সুকেশ আহত হন।

Advertisement

পুলিশের দাবি, কাপাসএড়িয়ার কাছে জাতীয় সড়কে থাকা সিগন্যাল পোস্ট ঠিকমতো লক্ষ না করার ফলেই ওই চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনে দাঁড়ানো অন্য একটি লরিকে ধাক্কা মারে। এতেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। শুধু এই দুই ঘটনা নয়, রাজ্য বা জাতীয় সড়ক আটকে চাঁদার জুলুমের ঘটনায় আতঙ্কিত পূর্ব মেদিনীপুরের লরি, ট্যাক্সি-সহ বিভিন্ন গাড়ির মালিক ব্যবসায়ী ও সাধারণ বাসিন্দারা। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কালীপুজোর চাঁদার নামে বিভিন্ন ক্লাব ও পুজো কমিটির লোকেরা জেলার বাজকুল, এগরা, তমলুক, পাঁশকুড়া, হলদিয়া, মেচেদা-সহ বিভিন্ন ব্যস্ত সড়কে রাস্তা আটকে দিনে-রাতে জোর করে টাকা আদায় করা করছে। অধিকাংশ সড়কে পুলিশি টহলদারি না থাকায় চাঁদা আদায়কারীরা গাড়িচালক-সহ আরোহীদের উপর রীতিমতো অত্যাচার চালাচ্ছে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে ভগবানপুরে জেলাশাসকের কনভয় আটকে চাঁদা আদায়ের চেষ্টার অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর জেলার প্রতিটি থানা এলাকায় চাঁদা আদায়কারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য তৎপরতা শুরু হয়। আর এতে তমলুক থানা এলাকায় বৃহস্পতিবার তিন জন চাঁদা আদায়কারীকে গ্রেফতার করা হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সুকেশকুমার জৈন অবশ্য বলেন, “জেলার বিভিন্ন সড়কে গাড়ি থেকে চাঁদা আদায় বন্ধ করতে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। চাঁদা আদায়ের অভিযোগে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কিছু লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এবিষয়ে নির্দিষ্ট অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

Advertisement

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার হলদিয়া-মেচেদা রাজ্য সড়ক, ৪১ নম্বর জাতীয় সড়ক, মেচেদা-দিঘা সড়ক, বাজকুল-এগরা ভায়া ভগবানপুর রাজ্য সড়ক, তমলুক-পাঁশকুড়া, তমলুক-শ্রীরামপুর, পাঁশকুড়া-ঘাটাল রাজ্য সড়ক প্রভৃতি রাস্তার বহু জায়াগায় বিভিন্ন ক্লাব-সহ পুজো উদ্যোক্তারা গাড়ি আটকে কালীপুজোর জন্য চাঁদা আদায় করছে। বিশ্বকর্মা পুজোর সময় থেকে জেলার এইসব ব্যস্ত সড়কে যাতায়াতকারী লরি, ট্যাক্সি, মেশিনভ্যান চালকদের আটকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। তবে দুর্গাপুজোর তুলনায় কালীপুজোর জন্য চাঁদা আদায়কারী ক্লাবের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় গাড়ি চালকদের হয়রানি বেড়েছে। তাছাড়া একাধিক পুজো কমিটিকে চাঁদা দিতে গিয়ে মোটা অঙ্কের টাকাও খরচ হচ্ছে বলে অভিযোগ। কালীপুজোর সময় এই চাঁদার জুলুম এড়াতে ব্যবসায়ীদের একাংশ পুজোর কিছুদিন আগে থেকেই বিভিন্ন স্থানে গাড়িতে করে মালপত্র নিয়ে আসা বা পাঠানো বন্ধ করে দেন বলে গাড়ি মালিকদের অভিযোগ।

তমলুক শহরের এক ব্যবসায়ীর মতে, ব্যবসার জন্য মালপত্র পাঠাতে গিয়ে চাঁদা আদায়কারীদের যে টাকা দিতে হয়, তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। তাই চাঁদা আদায়কারীদের এড়াতে লরিতে মালপত্র পাঠানো বন্ধ রাখা হয়। তমলুক শহরের হাসপাতাল মোড় ব্যবসায়ী সমিতি আবার প্রতিটি দোকানে রীতিমত ছাপানো নোটিস দিয়ে চাঁদা আদায়কারী পুজো উদ্যোক্তাদের দোকান থেকে আলাদাভাবে চাঁদা না নিয়ে সমিতির অফিসে যোগাযোগ করতে বলেছে। চাঁদার জুলুম এড়াতে বাস মালিক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে বিশ্বকর্মা পুজোর আগে থেকেই বাসের সামনের দিকে কাঁচে রীতিমতো পোস্টার সাঁটিয়ে গাড়ি আটকে চাঁদা আদায় করার পরিবর্তে অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে যোগাযোগ করতে বলা হয়। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা বাস ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সম্পাদক মহম্মদ সামসের আরেফিন শুক্রবার বলেন, “চলতি বছর শুধুমাত্র হলদিয়া-মেচেদা রুটের সড়কে বিভিন্ন স্থানের ১৪০টি কালীপুজো কমিটি চাঁদার জন্য আমাদের কাছে এসে রসিদ দিয়েছে। অধিকাংশ পুজো কমিটি গড়ে দুই-তিন হাজার টাকার রসিদ দিয়েছে। অনেকেই আবার টাকার উল্লেখ না করেই রসিদ দিয়েছে। এইসব পুজো কমিটিগুলিকে গড়ে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।”

জেলার বিভিন্ন স্থানে থাকা বড় পুজো কমিটিগুলি রাস্তায় বাস আটকে চাঁদা আদায় না করলেও পূর্ব মেদিনীপুর ডিস্ট্রিক্ট বাস অনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সুকুমার বেরা বলেন, “বাস আটকে চাঁদা আদায় না করার জন্য বাসের সামনে পোস্টার দেওয়া সত্বেও কিছু পূজা কমিটি সড়কে বাস আটকে চাঁদা করে থাকে। আর জেলার বিভিন্ন বড় দুর্গাপুজো ও কালীপুজো কমিটিকে চাঁদা দেওয়ার জন্য সব মিলিয়ে আমাদের সংগঠনকে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়।” জেলা পুলিশ সুপার বলেন, “ভগবানপুর, কাঁথি, তমলুক থেকে এখনও পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন