এলাকায় শান্তি ফিরেছে। স্কুলে স্কুলে আর যৌথ বাহিনীর ক্যাম্প করার প্রয়োজন পড়ে না, বন্ধ হয় না পড়াশোনা। শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিকাঠামোরও উন্নতি হয়েছে। জঙ্গলমহলে এই দিন বদলের প্রভাব পড়েছে এলাকার স্কুলগুলির মাধ্যমিকের ফলে। নজরে পড়ার মতো বেড়েছে পাশের হার। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা মনিটরিং টিমের কনভেনর নির্মলেন্দু দে জানান, ২০০৯-১০ সালে মাওবাদী অশান্তির পর্বে জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলগুলিতে মাধ্যমিকে পাশের গড় হার যেখানে ছিল ২৫-৩০ শতাংশ, এ বার সেই স্কুলগুলিতে গড় পাশের হার বেড়ে হয়েছে ৫৫-৬০ শতাংশ। সার্বিক ভাবে জঙ্গলমহলের স্কুলগুলিতে মাধ্যমিকে পাশের হার এ বার ৯০ শতাংশের কাছাকাছি বলেও জানান নির্মলেন্দুবাবু।
২০০৯-১০ সালে জঙ্গলমহলে মাওবাদী তৎপরতার পর্বে এলাকার স্কুলগুলির পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছিল। টানা বন্ধ-অবরোধের জেরে দীর্ঘ সময় লালগড়, বেলপাহাড়ি মতো মাওবাদী ঘাঁটিগুলিতে স্কুলগুলি দীর্ঘ দিন বন্ধ ছিল। স্কুলে স্কুলে যৌথ বাহিনীর ক্যাম্প থাকায় নিয়মিত ক্লাস করাও যেত না। স্বভাবতই তার প্রভাব পড়ত লেখাপড়ায়। এমনই একটি স্কুল লালগড়ের কাঁটাপাহাড়ি বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক অসীমকুমার গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “২০০৯ ও ২০১০ সালে পাসের গড় হার ৫০ শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছিল। গত বছর আমাদের স্কুলে পাসের হার ছিল ৬০ শতাংশ। এবার পাসের হার বেড়ে হয়েছে ৭০ শতাংশ।” বেলপাহাড়ি এসসি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সোমনাথ দ্বিবেদী জানান, ২০০৯ ও ২০১০ সালে পড়াশুনোর পরিস্থিতি ছিল না। সন্ত্রাস ও আতঙ্কের পরিবেশে মাধ্যমিকে পাশের হার ৪৫-৫০ শতাংশের আশেপাশে ছিল। সোমনাথবাবুর কথায়, “এখন দিন পাল্টেছে। গত দু’ বছরে (২০১২ ও ২০১৩) আমাদের স্কুলে পাশের হার বেড়ে হয়েছিল ৮০-৮২ শতাংশ। এ বার তা আরও বেড়ে ৯৫ শতাংশ হয়েছে।”
একই সুর শোনা গেল মানিকপাড়া হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা আল্পনা দত্তের গলায়। তিনি বলেন, “জঙ্গলমহলে অশান্তি পর্বে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় খুব ক্ষতি হয়েছিল। ওই সময় মাধ্যমিকে পাশের হার অনেকটাই কমে গিয়েছিল। এ বার আমাদের স্কুলে পাশের হার ৯৬ শতাংশেরও বেশি।” এই স্কুলেরই ছাত্র প্রসূণ দে এ বার ঝাড়গ্রাম মহকুমার মাধ্যমিক উত্তীর্ণদের মধ্যে এগিয়ে রয়েছে। তার প্রাপ্ত নম্বর ৬৬১। গোপীবল্লভপুরের ছাতিনাশোল এসসি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পুলকেশ মাহাতো জানালেন, ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে খুবই কম আসত। মাধ্যমিকে পাশের হারও তাই কম ছিল। ২০১১ পর্যন্ত এই স্কুলে পাশের গড় হার ছিল ৬০ শতাংশ। ২০১২ ও ২০১৩ সালে তা বেড়ে হয় যথাক্রমে ৬৫ ও ৭৮ শতাংশ। এ বার এই স্কুলে পাশের হার ৯০ শতাংশ। ছাত্রীদের পাশের হার আবার ছাত্রদের তুলনায় বেশি।
তবে শুধু মাওবাদী নাশকতায় দাঁড়ি নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং রাজ্য সরকারের উদ্যোগের ফলেই জঙ্গলমহলে মাধ্যমিকের ফল তুলনায় ভাল হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ। প্রশাসন সূত্রের খবর, গত তিন বছরে শুধু জঙ্গলমহল এলাকার ১১৭টি স্কুলকে উচ্চ মাধ্যমিকে উন্নীত করা হয়েছে। ফলে, প্রত্যন্ত এলাকার ছেলেমেয়েদের আর দূরের স্কুলে যেতে হয় না। অধিকাংশ স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ চালু রয়েছে। এ সবের জেরে স্কুলছুটের সংখ্যা কমেছে। এক সময় মাওবাদী উপদ্রুত নয়াগ্রাম ব্লকের খড়িকা ভীমার্জুন এসসি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অনুপকুমার জানা বলেন, “এখন স্কুলে এলে বইপত্র, পোষাক ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মিড ডে মিল পাচ্ছে পড়ুয়ারা। স্বভাবতই স্কুলছুটের সংখ্যা অনেক কমেছে। সর্বশিক্ষা মিশনের এটা বড় সড় সাফল্য।” মধ্যশিক্ষা পর্ষদের জেলা মনিটরিং টিমের কনভেনর নির্মলেন্দু দে-ও মানছেন, জঙ্গলমহলের সর্বত্র শিক্ষার প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ছিল না। গত তিন বছরে সেই পরিকাঠামোর অনেকটাই উন্নতি হয়েছে।
জঙ্গলমহলের স্কুল ছাত্রীদের সাইকেলের বিলির উদ্যোগও ভাল ফলের অন্যতম কারণ বলে মনে করছে শিক্ষা মহল। গোপীবল্লভপুরের নয়াবসান জনকল্যাণ বালিকা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা মমতা নাগ বলেন, “স্কুল-ছাত্রীরা সাইকেল পাওয়ায় দূরবর্তী এলাকা থেকে সহজে স্কুলে আসতে পারছে। মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তাই অনেকটা বেড়েছে। ছাত্রীদের উপস্থিতির হারও আগের তুলনায় বেড়েছে।” এই স্কুলে মাধ্যমিকে পাশের হার এ বার ৯২ শতাংশ।
জঙ্গলমহলের নামী স্কুলগুলিতে অবশ্য বিগত বছরগুলির মতো এ বারও পাশের হার একশো শতাংশ। তবে লক্ষ্যণীয়, এ বার সরকারি আদিবাসী স্কুলে নজিরবিহীন ভাবে পাশের হার একশো শতাংশ। রাজ্য অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর পরিচালিত ঝাড়গ্রামের একলব্য আদর্শ আবাসিক বিদ্যালয়ের ৩৫ জন আদিবাসী পরীক্ষার্থীর সবাই উত্তীর্ণ হয়েছে। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “এই প্রথম আমাদের স্কুলে মাধ্যমিকে একশো শতাংশ ছাত্রছাত্রী উত্তীর্ণ হল। নিরবিচ্ছিন্ন পঠন-পাঠন ও মূল্যায়নের ফলেই এই সাফল্য এসেছে।”