পত্রিকার প্রচ্ছদ। —নিজস্ব চিত্র।
কুড়ি ফুট বাই আট ফুটের দোকানটির গনগনে মাটির উনুনে ফুটন্ত চায়ের কেটলি!
সোশ্যাল নেটওয়াকির্ং সাইটের রমরমার যুগেও এখনও নিয়মিত দু’বেলা এখানে জমাটি আড্ডায় যোগ দেন নানা পেশার বিভিন্ন বয়সের লোকেরা। লালগড়ের এই ‘কফি হাউসে’ অবশ্য কফি মেলে না! অর্ধশতাব্দী প্রাচীন চায়ের এই দোকানটিই এলাকায় সাহিত্য চর্চার কেন্দ্রভূমি হিসেবে পরিচিত। দোকানের মালিক অশীতিপর মহাদেব রায়ের চা-চপের সুখ্যাতি এলাকাজোড়া। পাশাপাশি, দোকানের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে লালগড় থেকে প্রকাশিত একমাত্র ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘সুস্বন’-এর নাম।
‘সুস্বন’ কথার অর্থ ‘মধুর ধ্বনি’। নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রায় গত দেড় দশক ধরে প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকাটি। চা দোকান প্রাঙ্গণই কার্যত পত্রিকার যোগাযোগকেন্দ্র ও প্রাপ্তিস্থান। জঙ্গলমহলে সাহিত্য প্রতিভা বিকাশের আঁতুড়ঘরও বলা চলে। চায়ের গেলাসে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে পত্রিকাটির যুগ্ম সম্পাদক পঙ্কজকুমার মণ্ডল ও কিশোর তেওয়ারি জানাচ্ছেন, “মহাদেববাবুর পাশাপাশি, স্থানীয় বিভিন্ন পেশার মানুষজনের অকুন্ঠ সহযোগিতার কারণেই বেঁচে রয়েছে ‘সুস্বন’। এমনকী জঙ্গলমহলে ২০০৯-’১০ সালে মাওবাদী অশান্তিপর্বে লালগড় যখন উত্তাল, তখনও থেমে থেকেনি ‘সুস্বন’।” অশান্তির দিনে ‘লালগড় সংখ্যা’ প্রকাশ করে রীতিমতো সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন পঙ্কজবাবুরা। এ বার চোদ্দো তম বর্ষের ঝকঝকে শারদ সংখ্যাটির পরতে পরতে রয়েছে নানা মননশীল লেখা। পঙ্কজবাবুর কথায়, “লালগড়ে মহাদেবদার এই ‘কফি হাউস’টি না থাকলে হয়তো সুস্বনকে পাওয়া যেত না। ওনার উত্সাহেই ২০০১ সালে আমরা কয়েকজন মিলে পত্রিকাটি বের করি। তারপর বাকিটা ইতিহাস।”
স্থানীয়েরা জানালেন, মহাদেববাবুর দোকানের চা-আড্ডায় নানা ধরনের আলোচনা হয়। বিভিন্ন পেশার মানুষজন ওই আড্ডায় হাজির হন। পনেরো বছর আগে পঙ্কজবাবু-কিশোরবাবুরা তখন যুবক। সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছে রয়েছে। কী ধরনের পত্রিকা করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। মুস্কিল আসান করলেন মহাদেববাবু। বাতলে দিলেন পথ। সহজ সরল ভাষায় লেখা গল্প, প্রবন্ধ, কবিতার পাশাপাশি, এলাকার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলির সাল-তারিখ-সহ অতি সংক্ষিপ্ত তথ্য পঞ্জিকা নিয়মিত প্রকাশ করার পরামর্শ দিলেন। মহাদেববাবুর কথায়, “আমি বেশি দূর পড়াশুনা করিনি। তবে গত পঞ্চাশ বছর ধরে আড্ডার শ্রোতা হিসেবে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, সেই নিরিখেই পঙ্কজ-কিশোরদের বলেছিলাম, এলাকার উপযোগী লেখা ছাপলে স্থানীয়দের মধ্যে আগ্রহ বাড়বে। আমিই ওদের পত্রিকার প্রথম গ্রাহক। চায়ের সঙ্গে পত্রিকাও রাখি বিক্রির জন্য।”
তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের নথি অনুযায়ী, এখন পত্রিকাটির প্রচার সংখ্যা তিন হাজার। রাজ্যের বাইরেও গ্রাহক রয়েছেন। চা-আড্ডার সদস্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী কালিপদ, ব্যবসায়ী দেবীদাস রায়দের বক্তব্য, “সুস্বন আমাদের সাহিত্যমনস্ক করে তুলেছে। পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যায় তিনমাসের উল্লেখযোগ্য স্থানীয় ঘটনার তথ্যপঞ্জি থাকে। যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
চপ ভাজার ফাঁকে মহাদেববাবু বলেন, “আমাদের দুঃখ আছে, অভাব আছে। কিন্তু সব ভুলিয়ে নতুন করে বাঁচার আশা জাগায় মধুর ধ্বনি।”