নিয়মটা নিতান্তই স্পষ্ট— দান করা দেহ হাসপাতালে এলে নথিপত্র দেখে তা গ্রহণ করতে হবে।
অথচ নিয়মটা বদলে যায় বিকেল ফুরিয়ে গেলেই— ‘উঁহু সন্ধে হয়ে গিয়েছে, ফরমালিনে ভিজিয়ে দিচ্ছি, কাল নিয়ে আসুন!’
চেনা লব্জ। সরকারি হাসপাতালে অ্যানাটমি বিভাগে মরদেহ দান করতে গেলে এটাই শুনতে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছেন শেষ বিকেলের শব যাত্রীরা।
সেই তালিকায় শেষ সংযোজন টালিগঞ্জের প্রদ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার।
দিন কয়েক আগে, এমনই এক অভিযোগ পেয়ে ঘনিষ্ঠমহলে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রীও বলেছিলেন, ‘‘দেখবেন কেউ যেন ফিরে না যান!’’
সে কথা কী শুনতে পেয়েছিলেন এসএসকেএম কিংবা এনআরএস হাসপাতালের সুপাররা। নিশ্চয় নয়, না হলে জমশেদপুরে মারা যাওয়ার পরে টালিগঞ্জের ওই বৃদ্ধকে অমন ঘুরতে হয়!
সিদ্ধার্থবাবুর পরিবারের দাবি, কলকাতার ওই দুই সরকারি হাসপাতালে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল তাঁদের। আর দু’জায়গাতেই তাঁদের চেনা পরিভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল— কাল আনুন।
সোমবার জমশেদপুর থেকে ৮৫ বছরের বাবার মৃতদেহ এনেও তাই তা দান করতে পারল না ওই পরিবার। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সহয়োগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল কল্যাণী, কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজে দেহ গ্রহণ করে।
টালিগঞ্জ রিজেন্ট পার্কের ম্যুর অ্যাভিনিউ-এর বাসিন্দা প্রদ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায় কাঁচরাপাড়া রেল কারখানার অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্মী ছিলেন। ২০১২ সালে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে মরনোত্তর দেহ দান করেন তিনি। তাঁর পরিজনেরা জানাচ্ছেন, গত নভেম্বরে ৮৫ পূর্ণ করে। হোক বয়স, আমুদে মানুষটা ২১ ডিসেম্বর ভাই-বোনেদের নিয়ে ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুরে বেড়াতে যান। তাঁর জন্ম সেখানেই। ছোটবেলাও সেখানেই কেটেছে।
কিন্তু, ২৪ ডিসেম্বর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে ভর্তি করানো হয় টাটা হাসপাতালে। সোমবার সকালে মৃত্যু হয় তাঁর।
তার পরেই শুরু হয় দেহ দান করার চেষ্টা।
সংরক্ষণ করতে না পারায় চোখ দেওয়া যায়নি। এর পরেই দেহ নিয়ে তাঁরা ছোটেন কলকাতা।
প্রদ্যুৎবাবুর ছেলে সিদ্ধার্থ বলছেন, ‘‘বাবা আমাদের বলে গিয়েছিলেন, যেমন করেই হোক তাঁর মরনোত্তর দেহ যেন দান করা হয়। সেই জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অ্যাম্বুল্যান্সে করে কলকাতায় আনার সিদ্ধান্ত নিই।’’ কিন্তু কলকাতার দুটি মেডিক্যাল কলেজ জানিয়ে দেয়, বিকেলের মধ্যে দেহ আনতে পারলে, তবেই তাঁরা তা নিতে পারবেন।
সিদ্ধার্থবাবুর স্ত্রী নিবেদিতাদেবী বলেন, জামশেদপুর থেকে বেলা সাড়ে ১১টায় রওনা হয়ে বিকেলের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছনো সম্ভব ছিল না। তখন আমরা অথই জলে পড়ি। তা হলে কী হবে? তখন তাঁরা যোগাযোগ করেন চাকদহের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সম্পাদক বিবর্তন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি যোগাযোগ করেন কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের সঙ্গে। বিবর্তনবাবু জানান, অনুরোধ করতে তাঁরা রাজি হন।
শেষ পর্যন্ত রাত ন’টা নাগাদ দেহ এসে পৌঁছয় কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজে।