ঘটনা এক: মেদিনীপুর আদালত চত্বর। বেশ কয়েক মাস আগে কর্মব্যস্ত এক সকালে আদালত চত্বরে মোটর বাইক রেখে এজলাসে ঢুকেছিলেন এক অবিনাশ দে (নাম পরিবর্তিত)। শুনানি শেষে ফিরে এসে দেখেন বাহনটি নেই।
ঘটনা দুই: রোগীর পরিজনদের ভিড়ে ঠাসা খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতাল চত্বর। মাস খানেক আগে মোটর বাইক রেখে এক চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তপন মাহাতো (নাম পরিবর্তিত)। ফিরে দেখেন বাইকটি উধাও। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তাঁর। পুলিশে অভিযোগ জানিয়েও অবশ্য লাভ হয়নি।
ঘটনা তিন: মাঠে বাইরে মোটর বাইক রেখে ফুটবল খেলা দেখতে ঢুকেছিলেন খড়্গপুর পুরীগেটের বাসিন্দা ব্যবসায়ী কৈলাশ সাহু। ঘন্টা খানেক পরে বেরিয়ে আর খুঁজে পাননি তাঁর সাধের মোটর বাইকখানা। ৫ অক্টোবর খড়্গপুর চাঁদমারি ময়দানের এই ঘটনায় অভিযোগ দায়ের হয়েছিল টাউন থানায়। সেই ঘটনার তদন্তে নেমে জোর তল্লাশি শুরু করেছিল পুলিশ। অবশেষে দু’মাস পরে উদ্ধার হয় চুরি যাওয়া সেই মোটর বাইক। ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে চারজনকে গ্রেফতারও করে পুলিশ।
এ গুলির কোনটিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মেদিনীপুর-খড়্গপুরে প্রায়ই এ ভাবে চুরি হয়ে যাচ্ছে মোটর বাইক। কিনারা অবশ্য হচ্ছে নামমাত্র। এখানেই পুলিশের বিরুদ্ধে নজরদারিতে গাফিলতির অভিযোগ উঠছে। স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশি গাফিলতির অভিযোগ করছেন। পুলিশ অবশ্য দাবি করেছে, নজরদারি চলে। পাশাপাশি মোটর বাইক চুরি রুখতে এ বার সাদা পোশাকের পুলিশকেও পথে নামানো হয়েছে। পুলিশ মনে করছে, সাদা পোশাকে নজরদারি চালালে চোরাচালান চক্রকে হাতেনাতে ধরাও সম্ভব হতে পারে।
অন্য দিকে পুলিশি নজরদারিতে সন্তুষ্ট নন রেলশহরের বাসিন্দারাও। শুধু মাত্র মোটর বাইক চুরির পরিসংখ্যান দেখলেই সেই অসন্তোষের কারণ স্পষ্ট হয়ে যায়। ২০১৪ সালে চুরি যাওয়া ৩৬টি বাইকের চারটি উদ্ধার হয়। গ্রেফতার করা হয় ১২ জনকে। এ বছর নভেম্বর পর্যন্ত চুরি যাওয়া ২৮টি বাইকের মধ্যে উদ্ধার করা গিয়েছে মাত্র ন’টি। তবে চুরির ঘটনায় ২৭জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মেদিনীপুর শহরে প্রতিমাসে ৪-৫টি করে বাইক চুরি যাচ্ছে। মাস কয়েক আগে সদর শহরে দু’দিনে ৭টি বাইক চুরির নজিরও রয়েছে।
খড়্গপুর টাউন থানার পুলিশ জানিয়েছে কৈলাশ সাহুর মোটর বাইক চুরিতে সম্প্রতি বিশ্বজিৎ সরেন নামে কৌশল্যার এক যুবকের নাম পাওয়া যায়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে উঠে আসে সোনামুখীর দীপক ঠাকুর, কৌশল্যার সৈকত বসু ও সাউথ সাইডের মিকি অ্যান্টনির নাম। গত রবিবার রাতে এই তিনজনের বাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। মিকির বাড়ি থেকেই উদ্ধার হয় কৈলাশবাবুর খোয়া যাওয়া মোটর বাইকটি। এরপর বিশ্বজিৎ-সহ চারজনকেই গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশের দাবি এলাকায় মোটর বাইক চুরির যে চক্র রয়েছে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাশের জেলার চক্রও। ফলে রাতারাতি মোটর বাইক পাচার হয়ে যাচ্ছে অন্যত্র। স্থানীয় চোরেদের গ্রেফতার করলেও উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না খোয়া যাওয়া বাইক। এক পুলিশ কর্মী জানিয়েছেন, মূলত পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কিছু চক্র সক্রিয় রয়েছে এই জেলায়। স্থানীয় চোরেদের কাজে লাগাচ্ছে তারা। চুরি করা মোটর বাইকের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হচ্ছে ছোট মাছ ধরার নৌকো ও ভুটভুটিতে। তা ছাড়াও ছিনতাই, ডাকাতির মতো নানা দুষ্কর্মে ব্যবহার চুরি করা মোটর বাইক।
পরিসংখ্যান বলছে মোটর বাইক চুরির ঘটনা বেশি ঘটে পুজোর সময়ে বা তার মাস খানেক আগে। বাজার এলাকায় কেনাকাটার ভিড়ে সহজেই গায়েব করে দেওয়া যায় মোটর বাইক। তবে ইদানীং পুজোর সময় বেড়েছে পুলিশি নিরাপত্তা। তাই এই সময় চুরির ঘটনা খানিকটা কম করা গিয়েছে বলে পুলিশের দাবি। যেমন চলতি বছরের অক্টোবরে খড়্গপুর শহরে চুরি হয়েছে তিনটি মোটর বাইক। কিন্তু জুলাই মাসে চুরি হয়েছে সাতটি। এটিই এ বছরের সর্বাধিক।
প্রায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনও কিনারা করতে পারে না পুলিশ। ইন্দার বাসিন্দা অভিষেক গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “মাস চারেক আগে পাশেই এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বাড়ির সামনে থেকে মোটর বাইক চুরি হয়ে গেল। পুলিশে জানিয়েছিলাম। কোনও লাভ হয়নি।” সাধারণ বাসিন্দারা প্রায় সকলেই বলেছেন নিয়মিত নজরদারি চালালে বা রাস্তায় টহল দিলে এই চক্রকে রোখা সম্ভব।
কেন এড়ানো যাচ্ছে না এ ভাবে মোটর বাইক চুরির ঘটনা? জেলা পুলিশ সুপার নিরুত্তর। জেলা পুলিশেরই এক কর্তার কথায়, “এমন ঘটনা এড়াতে গেলে আগে দুষ্টচক্রগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। চক্রের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে, মূল পাণ্ডাদের এখনও পাকড়াও করা সম্ভব হয়নি। খোঁজ চলছে।” অনেকেই বলছেন ইদানীং শহর এবং শহরতলিতে মোটর বাইকের সংখ্যাও বেড়েছে। দুই শহরের নতুন প্রজন্মই এখন দামী মোটর বাইকে মজেছে। ৬০-৭০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে লক্ষাধিক টাকাতেও তাদের না-নেই। ফলে চোরেদের কাছে প্রলোভনও বাড়ছে।
পুলিশেরই এক সূত্রে খবর, আগে ধরা পড়া চোরচালানচক্রের সঙ্গে জড়িতদের জেরা করে জানা গিয়েছে, মেদিনীপুর শহরে বাইক চুরির সঙ্গে জড়িত দুষ্টচক্রের সংখ্যা তুলনায় কম। খড়্গপুর শহর এবং খড়্গপুর গ্রামীণ এলাকায় সংখ্যাটা বেশি। চন্দ্রকোনা রোড এলাকাতেও হাত রয়েছে ওই সব চক্রের।
সহ-প্রতিবেদন: বরুণ দে।