ফিরলেন কফিনবন্দি রাজীব

ন’দিন ধরে ছেলের অপেক্ষায় কাটিয়েছেন বরাহনগরের সাধনা ভট্টাচার্য। বারবার শুধু বলেছিলেন, ‘‘বাপি এক বার ফিরে আয়, এক বার মা বলে ডাক বাবা।’’

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৬ ০৩:৩৩
Share:

বরাহনগরে রাজীবের কফিন। ইনসেটে ছেলের কফিনের সামনে মা। শনিবার। —নিজস্ব চিত্র।

ন’দিন ধরে ছেলের অপেক্ষায় কাটিয়েছেন বরাহনগরের সাধনা ভট্টাচার্য। বারবার শুধু বলেছিলেন, ‘‘বাপি এক বার ফিরে আয়, এক বার মা বলে ডাক বাবা।’’

Advertisement

শনিবার সন্ধেয় বাপি ফিরলেন। কফিনবন্দি হয়ে।

ধৌলাগিরি অভিযানে গিয়ে মৃত্যু হয় পর্বতারোহী রাজীব ভট্টাচার্য ওরফে বাপির (৪১)। ১৯ মে খবর পৌঁছোয় বাড়িতে। ৭৫ বছরের বৃদ্ধা মাকে প্রথমে সে কথা জানাতে চাননি পরিজনেরা। কিন্তু লুকিয়ে রাখা যায়নি ছেলের মৃত্যুসংবাদ। পর দিন সকালে টিভির ‘ব্রেকিং নিউজে’ সাধনাদেবী জেনেছিলেন, বাপির ‘বিপদের’ কথা। এ দিন সন্ধেয় কফিনের ভিতরে ছেলের মুখ দেখে হাহাকার করে বলেছেন, ‘‘এ ভাবে এলি বাবা!’’

Advertisement

খারাপ আবহাওয়ার জন্য বেশ ক’দিন ধরে ধৌলাগিরি থেকে উদ্ধার করা যায়নি রাজীবের দেহ। অবশেষে শুক্রবার তা সম্ভব হয়। শনিবারই কাঠমান্ডু থেকে কফিনবন্দি হয়ে রাজীব ফিরছেন, সকালেই জানা গিয়েছিল সেই খবর। তার পর থেকেই নিস্তব্ধ বরাহনগর মিলনগড়। পাড়ায়-পাড়ায় রাজীব স্মরণে ফ্লেক্স, পোস্টার পড়ে। তৈরি হয় একাধিক মঞ্চ। ‘গার্ড অব অনার’-এর প্রস্তুতি নিতে পৌঁছে যায় ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পুলিশ।

স্থানীয়রা বলছেন, প্রতি বারের মতো শৃঙ্গ ছুঁয়ে এসে এ বার যে আর ‘মা’ বলে বাপি ডাকবে না, তা বুঝেছিলেন সাধনাদেবীও। সকাল থেকেই বিছানা নিয়েছিলেন। হাজার চেষ্টায় এক ফোঁটা জলও খাওয়ানো যায়নি তাঁকে। এক প্রতিবেশীর কথায়, ‘‘দু’বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন। দোতলা বাড়িতে মা আর ছেলে নিয়েই ছিল সংসার। ছেলেটাও চলে গেল!’’

রাজীবের মরদেহ নিতে বিকেলে বিমানবন্দরে পৌঁছন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী লক্ষ্মীরতন শুক্ল। পুলিশি কনভয় নিয়ে ছিলেন বরাহনগর থানার আইসি রাম মণ্ডল। সন্ধেয় বরাহনগর মাতৃমন্দির দুর্গামণ্ডপের মাঠে পৌঁছয় রাজীবের দেহ। ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয় তাঁকে। মালা দেন মন্ত্রী, ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজ সিংহ। সেখান থেকে কফিন কাঁধে রাজীবের বাড়ি নিয়ে যান স্থানীয়রা। ‘কাকা’-কে এ ভাবে ফিরতে দেখে ভেঙে পড়ে ভাইঝি পৃথা। বলেন, ‘‘এভারেস্ট জয় করে ফেরার সময় পাড়ার লোকেই কাকাকে কাঁধে করে বাড়ি নিয়ে এসেছিল। এ বারও কাঁধে করেই ফিরল কাকা। কফিনে!’’

রাজীবকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন স্থানীয় বিধায়ক তাপস রায়, উত্তর দমদমের বাম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য-সহ রাজনৈতিক নেতারা। তাপসবাবু বলছিলেন, ‘‘পাঁচ বছর আগে বিধায়ক হয়ে এভারেস্টজয়ী রাজীবের গলায় মালা পরিয়েছিলাম। এ বার বিধায়কের শপথ নেওয়ার দিনে ওঁর নিথর দেহে মালা দিতে হচ্ছে!’’ ভিড়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন জ্যোতির্ময় গায়েন। তাঁর বোন ছন্দা গায়েনও পাহাড়ের কোলেই হারিয়ে গিয়েছেন। সে বারে ছন্দার সহ-অভিযাত্রী ছিলেন এই রাজীবই। জ্যোতির্ময় বললেন, ‘‘বোনকে আগেই হারিয়েছিলাম। ভাইকেও হারালাম।’’

কফিনবন্দি ছেলের মুখ দেখানোর জন্য ঘর থেকে নিয়ে আসা হয় সাধনাদেবীকে। প্লাস্টিক ছিঁড়ে মুখটুকু শুধু বার করে দেওয়া হয়। আদরের ‘বাপি’-কে শেষ বারের মতো দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি বৃদ্ধা মা। কিছু ক্ষণের মধ্যেই রাজীবের দেহ নিয়ে শ্মশানঘাটে রওনা দেন পরিজন-বন্ধু-পুলিশকর্তারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন