এক পাড় ভাঙছে। অন্য পাড় তখন নতুন করে গড়ার ইঙ্গিত। এক গাছে মুকুল ঝরছে। অন্য অনেক গাছে তখন নতুন ফুল ধরার আশা! এমনই ভাঙা-গড়ার খেলা চলছে এখন তৃণমূলে!
মাত্র ক’দিন আগেও যাঁরা দলের লাইনের বাইরে গিয়ে প্রকাশ্যে ভিন্ন সুর গেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, তৃণমূলে এখন তাঁরাই মুকুল রায়ের কট্টর সমালোচনায় মুখর। সকলেরই লক্ষ্য, দলনেত্রীর সুনজরে থাকা! তাঁর একদা বিশ্বস্ত সেনাপতি মুকুলের প্রতি তৃণমূল নেত্রীর রোষ যত বাড়ছে, মুকুল-নিন্দার প্রাবল্যও ততই বাড়ছে! মুকুল-সমালোচকেরা যতই বলুন দলকে বাঁচাতেই তাঁরা যা বলার বলছেন, প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের মুণ্ডপাত করতে তৃণমূলের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা নজর এড়াচ্ছে না।
যাদবপুর-কাণ্ডে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সাধন পাণ্ডে শাসক দলের লাইনের বাইরে কথা বলে তৃণমূল নেতৃত্বকে বিড়ম্বনায় ফেলেছিলেন। সেই সাধনবাবু এখন প্রায় তুলোধোনা করছেন তাঁর দলের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে। উত্তর কলকাতায় দলীয় কর্মিসভায় মুকুলকে দলের পক্ষে ‘ক্ষতিকারক’ আখ্যা দিয়ে সাধনবাবু বলেছেন, “ও এখন বিজেপির খপ্পরে পড়ে গিয়েছে। বিজেপি ওকে এখন বলছে, পার্টিতে নেব না। কিন্তু তুমি তৃণমূলে থেকে এই পার্টির ক্ষতি করো!” সাধনবাবুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে মুকুলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ছেন কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষও। বহু দিন ধরে পুর-রাজনীতিতে যুক্ত থেকেও অতীনের ভাগ্যে মেয়রের পদ জোটেনি। সামনে পুরভোট। দলের একাংশের মতে, “সঠিক সময়েই নেত্রীর নজরে থাকতে অতীন ঠিক পথই ধরেছেন!”
পুরভোটের পরেই বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতি শুরু হবে। সদ্য দুই উপনির্বাচনের ফল দেখে আগামী বিধানসভার কথা মাথায় রেখেই সাধনবাবু ভোল বদলেছেন বলে দলের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন। সাধনবাবু অবশ্য যুক্তি দিচ্ছেন, “আমি দলের বিশ্বস্ত সৈনিক। দলটাকে তো বাঁচাতে হবে! তাই উচিত কথা বলে আমি ঠিক কাজই করেছি। এ নিয়ে অন্য কিছু ভাবার বা ব্যাখ্যা করার নেই!”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কৃতী ছাত্রী গীতশ্রী সরকারের ‘অহিংস’ প্রতিবাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রতবাবু। তাঁর সেই বক্তব্য শুনে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী দলের নেতা ও মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে দিয়ে পাল্টা বিবৃতি জারি করিয়েছিলেন। এমনকী, সুব্রতবাবুর পঞ্চায়েত দফতরের একটি বিভাগে মুখ্যমন্ত্রী জুড়ে দিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্নাকে। মুকুল-বিতর্ক মাথা চাড়া দেওয়ার পরে সুব্রতবাবুর মতো প্রবীণ নেতাকে আবার মুখ্যমন্ত্রীই কাছে টেনে নিয়েছেন। বিধানসভায় বাজেট পেশ হওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কক্ষে বসেছিলেন ছবি আঁকতে। কারণ? সেই ছবি তিনি উপহার দেবেন তাঁর ‘সুব্রতদা’কে! মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “আমায় ছবি আঁকাতে খুব উৎসাহ দেন সুব্রতদা।” দলের এক রসিক নেতার মন্তব্য, “সুব্রতদা সুযোগ-সন্ধানী রাজনীতিবিদ জানি। এখন শিল্পের সমঝদারও বটে!”
যে কোনও দিন তিনি বিজেপিতে নাম লেখাতে পারেন বলে ভাটপাড়ার বিধায়ক অর্জুন সিংহকে নিয়ে জল্পনা ছিল লোকসভা ভোটের সময় থেকেই। এখন দলের অন্দরেই সেই অর্জুন ‘বিশ্বস্ত’ বলে সম্মানিত হচ্ছেন। আসন্ন পুরভোটে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে দলের বড় দায়িত্বও নিয়েছেন। মুকুলের পতনই দলের প্রতি অর্জুনের ‘আনুগত্য’ ফিরিয়ে এনেছে! অর্জুন বলেছেন, “দেরিতে হলেও মুকুল রায়ের ব্যাপারে দল সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” তাঁর নেতৃত্বে কাঁচরাপাড়ায় মুকুল-বিরোধী মিছিলও হয়েছে। তৃণমূলের গোষ্ঠী রাজনীতিতে মুকুল-বিরোধী বলেই অর্জুন পরিচিত। কাঁচরাপাড়া-বীজপুর এলাকায় মুকুলের জমিতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অর্জুন যেমন সক্রিয় হয়েছেন, তেমনই সামনে ভাটপাড়ার পুরভোটে কর্তৃত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে এগোচ্ছেন। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ‘গুরু’ মেনে চলা বহিষ্কৃত নেতা আরাবুল ইসলামও মুকুল-জমানার অবসান দেখে সুযোগ বুঝে তৃণমূল নেত্রীকে প্রণাম ঠুকে যাচ্ছেন!
একদা মুকুল-বিরোধী বলে পরিচিত যে শুভেন্দু অধিকারীকে দলের যুব সংগঠনের রাজ্য সভাপতির পদ থেকে ছেঁটে ফেলেছিলেন, তাঁকে কাছে টানতে এখন দলের কার্যকরী কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদে উন্নীত করেছেন মমতা। শুভেন্দু তাঁর প্রাপ্য গুরুত্ব পাচ্ছেন না বলে দলে বিভাজন তৈরির একটা চেষ্টা মুকুল করলেও তা বিশেষ ফলপ্রসূ হচ্ছে না। কারণ শুভেন্দু-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, একদা তমলুকের সাংসদকে বেকায়দায় ফেলতে মুকুল তাঁর ঘনিষ্ঠ এক বিধায়ককে কাজে লাগিয়েছিলেন। শুভেন্দু সেটা ভোলেননি। কৌশলী রাজনীতিক শুভেন্দু অবশ্য সাধনবাবুদের মতো মুকুলের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে যাননি। তবে ঘটনাচক্রে, মুকুল-ঘনিষ্ঠ সেই বিধায়কও এখন শুভেন্দুদের সঙ্গে দলের মূল স্রোতেই রয়েছেন।
দলে নিজেদের হারানো জমি ফিরে পেতে সাধন-অতীন-অর্জুনেরা যে কাণ্ড-কারখানা শুরু করেছেন, তা নিয়ে অবশ্য দলেই অন্য প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। দলের নেতাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলে সিউড়ির তৃণমূল বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষ বা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী হুমায়ুন কবীরকে যদি শাস্তির মুখে পড়তে হয়, তা হলে এঁদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেন হবে? পদ হারালেও মুকুল তো এখনও তৃণমূল নেতা ও সাংসদ! তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আক্রমণ কি শৃঙ্খলাভঙ্গ নয়? দলের মহাসচিব পার্থবাবু অবশ্য মনে করেন, “মুকুল সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করা উচিত নয়। মুকুল এখনও তৃণমূলে আছে।” কিন্তু শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে কোনও পদক্ষেপ হচ্ছে না! দলের এক প্রথম সারির নেতার তির্যক মন্তব্য, “মুকুলের সমালোচনা করলে নেত্রী খুশি হবেন। এটা জেনেই ব্যতিক্রম হচ্ছে!”
আর এ সব দেখে কী করছেন মুকুল? প্রথমত, তিনি আদ্যন্ত ‘উপভোগ’ করছেন! আর দ্বিতীয়ত, শক্রর শত্রু আমার মিত্র মমতার মতোই এই নীতি মেনে তৃণমূলের মধ্যে বিক্ষুব্ধ স্বর দেখলে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন! দু’দিন আগেই দিল্লিতে বিধায়ক স্বপনের পাশে দাঁড়িয়ে যেমন দরাজ বিবৃতি দিয়েছেন! কী ভাবে দেখছেন ধেয়ে আসা নানা তোপকে? মুকুলের জবাব তাৎপর্যপূর্ণ “আসলে দলের মধ্যে যাঁরা সন্দেহভাজন, সন্দেহ কাটাতে তাঁদের এ রাস্তা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই!”