গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ আগেও জমা পড়ত। কিন্তু তার প্রায় কোনওটিকেই তেমন আমল দেওয়া হয়নি। বরং বেসরকারি হাসপাতালের উপরে সরকারের ‘সরাসরি নিয়ন্ত্রণ না থাকা’র অজুহাত দেখিয়েই এতদিন বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতেন স্বাস্থ্যকর্তারা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নড়েচড়ে বসতেই কার্যত যুদ্ধকালীন তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছে স্বাস্থ্য দফতরে। ফাইল ঘেঁটে এক দিনেই বেরিয়ে এসেছে আড়াইশো অভিযোগ। এর অধিকাংশই কলকাতা ও তার আশপাশের বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। গত তিন বছরে বিভিন্ন সময়ে এগুলি জমা পড়েছিল।
প্রায় তামাদি হতে চলা ওই অভিযোগগুলিকেই এখন নেড়েঘেঁটে দেখছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, আগামী সপ্তাহে মু্খ্যমন্ত্রী যখন হাসপাতালগুলির কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন, তার আগে তাঁকে পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহের চেষ্টা হবে ওই সব অভিযোগের ভিত্তিতেই।
রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব রাজেন্দ্র শুক্লা এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করবেন না বলে জানিয়েছেন। তবে স্বাস্থ্য দফতরের অন্যান্য শীর্ষকর্তারা জানান, কেন এত দিন বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ ভাবে রেয়াত করা হয়েছে, তার কৈফিয়ত চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। দফতরের এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিন-চারটি হাসপাতালের বিষয়ে তাঁর কাছে লাগাতার অভিযোগ এসেছে। আর সব ক’টি ক্ষেত্রেই অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন, তাঁরা স্বাস্থ্য দফতরে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে কোনও প্রত্যুত্তর পাননি। কেন স্বাস্থ্য দফতর যথাযথ পদক্ষেপ করেনি, তার কৈফিয়ত চেয়েছেন তিনি।’’
আরও একটি ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী কৈফিয়ত চেয়েছেন বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর। এ রাজ্যে ক্লিনিক্যাল এস্ট্যাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট তৈরি হলেও তার বিধি এখনও তৈরি হয়নি। ফলে বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে সরকারের রাশ যথেষ্টই আলগা। কেন এত দিনেও বিধি তৈরি হল না, তা জানতে চাওয়ার পাশাপাশি দু’মাসের মধ্যে বিধি কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী বেসরকারি হাসপাতালগুলির খরচ এবং চিকিৎসা পদ্ধতির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরেই নড়েচড়ে বসেছে ক্রেতা সুরক্ষা দফতর। আর স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাও বুঝেছেন, তাঁদেরও নড়েচড়ে না বসে উপায় নেই। এই কারণেই বেসরকারি হাসপাতালগুলির লাইসেন্স রিনিউ করার ফাইলগুলিও ‘আপ়ডেট’ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ স্বীকার করে নিয়েছেন, লাইসেন্স দেওয়া বা তার রিনিউয়ালের ক্ষেত্রে বহু সময়েইে ঠিকঠাক পরিদর্শন হয় না। লোকাভাবের কারণেই বিষয়টি জোড়াতালি দিয়ে চলে। ২৩ তারিখের বৈঠকের আগে সে ব্যাপারেও নিজেদের যাবতীয় বক্তব্য প্রস্তুত রাখছেন তাঁরা।
বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে তাদের বিষয়ে রোগীদের একাধিক অভিযোগ জমা পড়লেও সরকারের তরফে তাদের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে নামমাত্র ক্ষেত্রে। ব্যবস্থা নেওয়ার নজিরও প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে হাসপাতালগুলি যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, সরকার যে তাতে কোনও ভাবেই হস্তক্ষেপ করবে না, তা এক প্রকার অভ্যাসই হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটি বেসরকারি হাসপাতালের সিইও রূপক বড়ুয়া জানান, তাঁরা সরকারের সক্রিয়তাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা যেন বজায় থাকে। তিনি বলেন, ‘‘প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে কিছু ভুল হয়েই যায়। কিছু অভিযোগও আসে। ঠিক ভাবে পারফর্ম করার জন্য নজরদারি জরুরি। আশা করব, ভবিষ্যতেও এটা থাকবে।’’
আর এক হাসপালের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান কুণাল সরকারের কথায়, ‘‘স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ জরুরি। যতই বেসরকারি হাতে স্বাস্থ্যের আংশিক ভার যাক না কেন, নদরজারি থাকতেই হবে। আমরা চাই সরকার আরও খুঁটিয়ে দেখুক। কিন্তু কোনও একটি হাসপাতালে গুন্ডামি, বর্বরতার পরিপ্রেক্ষিতেই যদি এই সক্রিয়তা শুরু হয়, তা হলে সেটা আক্ষেপের বিষয়। কারণ এই দু’টি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ক্ষেত্র।’’
আর এক হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার অরিন্দম বন্দোপাধ্যায়ও বলেছেন, ‘‘সরকার হাসপাতালগুলিকে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে বাধ্য করুক। তা হলেই দুধ আর জলের পার্থক্যটা বোঝা যাবে। তবে আমরা চাইব, এই সক্রিয়তার ধারাবাহিকতা যেন থাকে।’’