সাঁজোয়াল সমাজ সঙ্ঘের সদস্যরা।
যেন ভিন্ন মাত্রা পেল সহমর্মিতা। যেন আরও সুমধুর হল সম্প্রীতির সুর!
গত এক বছরের মধ্যে এই পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। বাড়িতে আছেন এক দম্পতি। সেই যুবকও আবার ক্যান্সারে আক্রান্ত। তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। প্রতি বছর এই বাড়ির সামনের মাঠ থেকেই ঢোল বাজিয়ে মহরমের শোভাযাত্রার সূচনা হয়। কিন্তু এ বার ছন্দপতন! ওই বাড়িটি একটি হিন্দু পরিবারের। কিন্তু, এই পরিবারের দুরবস্থার কথা ভেবে, তাদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে মহরমের শোভাযাত্রা এ বার বের হয়নি। মহরমের তাজিয়া সমেত শোভাযাত্রার খরচ বাঁচিয়ে ক্যান্সার আক্রান্ত যুবকের হাতে আর্থিক সাহায্য তুলে দিতে উদ্যোগী হয়েছে এলাকার মুসলিম সমাজ।
এমনই এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির দেখা গেল খড়্গপুরের সাঁজোয়ালে। শুক্রবার থেকে শহরের পুরাতন বাজারের ‘সাঁজোয়াল সমাজ সঙ্ঘ’ নামে একটি মুসলিম সমাজ ওই ক্যান্সার আক্রান্ত যুবকের পাশে দাঁড়াতে টাকা সংগ্রহের কাজে নামল। গত রবিবার তারা মহরমের শোভাযাত্রা বের করেনি। ওই পাড়ার ভুঁইয়া পরিবারের ছেলে বছর পঁয়ত্রিশের আবির ভুঁইয়া ওরফে বাবিন ক্যান্সারে আক্রান্ত বলে সম্প্রতি জানা গিয়েছে। ইতিমধ্যেই দু’বার কেমো দেওয়া হয়েছে তাঁকে। কলকাতার ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে তাঁকে শনিবার তৃতীয় বারের জন্য কেমো দিতে ভর্তি করা হয়েছে। মুম্বইতে হবে পরবর্তী চিকিৎসা। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন অন্তত ১২ লক্ষ টাকা। স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। বছরখানেকের মধ্যে মারা গিয়েছেন তাঁর বাবা, মা ও ঠাকুমা। এমন পরিস্থিতিতে পেশায় ডিশ টিভির রিচার্জ ব্যবসায়ী আবির দিশাহারা। তাই পাড়ার ছেলের পাশে দাঁড়াতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মহম্মদ বিলাল, আমজাদ খানেরা। এ বার মহরমের শোভাযাত্রা না করে এ দিন থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে পাড়ার ছেলে বাবিনকে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা শুরু করলেন এই মুসলিম পড়শিরা। এমন সহমর্মিতায় ভরা সম্প্রীতির আবেগে আপ্লুত ক্যান্সারে আক্রান্ত আবির ও তাঁর স্ত্রী।
আরও পড়ুন:
উৎসবের শহরে আজও ব্রাত্য ওরা
হোমেই লক্ষ্মীলাভ লক্ষ্মীছাড়া মেয়ের
এ বছর থানার উদ্যোগে হওয়া মহরম ও দশেরা কমিটির প্রথম বৈঠকে আবির ভুঁইয়ার কথা তুলেছিলেন সাঁজোয়াল শান্তি কমিটির সভাপতি তথা পাড়ার মুসলিম সমাজের উপদেষ্টা মহম্মদ বিলাল। সেই সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে পাঁচবেড়িয়া স্টার ক্লাব মহরম কমিটি ও দশেরা কমিটি পাঁচশো টাকা করে মোট হাজার টাকা দেয়। সাহায্যের আশ্বাস দেন বৈঠকে উপস্থিত পুরপ্রধানও। তার পরে মহরমের দ্বিতীয় বৈঠকে উপস্থিত থেকে সাঁজোয়াল সমাজ সঙ্ঘ জানিয়ে দেয়, আবিরের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তারা মহরমের শোভাযাত্রা বের করবে না। সেই কথামতো এ বার তারা ওই শোভাযাত্রা বের করেনি। এমনকী, কোনও চাঁদাও আদায় করেনি। পুজো ও মহরমের সময়ে সকলের পকেটে টান থাকায় মহরমের শেষে শুক্রবার থেকে তারা আবিরের চিকিৎসার জন্য চাঁদা সংগ্রহে নামবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কথামতো এ দিন থেকেই সেই তৎপরতা দেখা গেল।
অবশ্য এর আগে গত সোমবার বেনাপুরে আবিরের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে বৈঠকে সংগৃহীত হাজার টাকা তুলে দিয়ে এসেছিলেন পাড়ার মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিরা। আশ্বাস দিয়েছেন পাশে থাকার। ঘটনায় আবিরের মুখে হাসি ফুটলেও চোখে ধরা পড়েছে আবেগের জল। আবির বলছেন, “আমি কতটা সুস্থ হব সেটা আমি নিজেও জানি না। তৃতীয় বারের জন্য কেমো নিতে ভর্তি হলাম। কিন্তু আমার মতো এক জন হিন্দু ছেলের জন্য মহরমের শোভাযাত্রা বন্ধ করা হয়েছে। গোটা মুসলিম সমাজ আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। একটা মানুষের কাছে এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে।” স্থানীয় কাউন্সিলর তুষার চৌধুরী বলেন, “আমার এলাকায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি বরাবরের। এ বার পাড়ার যুবক বাবিনের ক্যান্সার হওয়ায় মহরমে মুসলিম সমাজ যে সৌজন্য দেখাল তাকে স্যালুট জানাচ্ছি।” আর মুসলিম সমাজের উপদেষ্টা তথা পাড়ার শান্তি কমিটির সম্পাদক মহম্মদ বিলালের কথায়: “পাড়ার একটি যুবকের এমন অবস্থা আর আমরা ঢোল পিটিয়ে মহরমের শোভাযাত্রা বের করব, এই মানসিকতা ছিল না। আমরা জানি মানুষের সেবা করলেই ঈশ্বর সন্তুষ্ট থাকেন। তাই এই প্রয়াস। আমরা তাই পুজো-মহরমের শেষে মানুষের কাছে আবিরের চিকিৎসার জন্য সাহায্য সংগ্রহে বেরিয়েছি।”