মণিপুরি রাসনৃত্য। নিজস্ব চিত্র
স্বপ্ন দেখছেন রাজা। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধিকা এবং গোপিনীদের সঙ্গে রাসলীলারত!
মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র ঠিক করলেন, স্বপ্নে দেখা সেই রাসকে ধরে রাখতে হবে আস্বাদনের জন্য। সঙ্গীতজ্ঞ রাজা ভাগ্যচন্দ্র বৈষ্ণব শাস্ত্রগ্রন্থ ঘেঁটে তাঁর স্বপ্নে দেখা রাসনৃত্যকে অনুপম রূপ দিলেন। বৈষ্ণবদর্শনে বলা হয়, শ্রীকৃষ্ণের সর্বোত্তম লীলা রাস। একমেবাদ্বিতীয়ম্ পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে বহুধা বিভক্ত করে গোপিনীদের সঙ্গে নৃত্য করেছিলেন। বৈষ্ণব দর্শনের সেই ভাবনাকে মাথায় রেখে মণিপুররাজ ভাগ্যচন্দ্র রাসলীলার নতুন উপস্থাপনা করলেন। নৃত্য-গীত-বাদ্যে সমাহারে এক অপূর্ব নৃত্যশৈলীর জন্ম হল। সময় অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। যদিও সময় নিয়ে মতপার্থক্য আছে গবেষকদের মধ্যে।
কথিত আছে, রাসলীলা রচনার পর ভাগ্যচন্দ্র পরিকল্পনা করেছিলেন রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহকে রাসমণ্ডলীর মাঝে রেখে শিল্পীরা নতুন আঙ্গিকের এই নৃত্য উপস্থাপন করবেন। বৈষ্ণব গ্রন্থে রাসনৃত্যকে ‘হল্লীষক’ নৃত্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বৈষ্ণব ভাবনার অনুসারী হয়ে বহু নৰ্তকীযুক্ত রাসনৃত্য নির্মাণ করেন ভাগ্যচন্দ্র।
কার্তিক পূর্ণিমার রাস তিথিতেই মণিপুরে প্রথম মহারাজ নির্মিত রাস প্রকাশ্যে উপস্থাপন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হল। কিন্তু হঠাৎ এক বিপত্তি। রাধারানির বিগ্রহের গায়ের রং কিছুতেই শুকোচ্ছে না। চিন্তায় পড়ে গেলেন মহারাজ। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, রাজকন্যা বিম্বাবতী স্বয়ং রাধার ভূমিকায় নৃত্য পরিবেশন করবেন। মহারাজ স্বয়ং সেই রাসনৃত্যে মৃদঙ্গ সঙ্গত করেছিলেন।
মণিপুরের সংস্কৃতিতে রাসলীলা এক স্বতন্ত্রধারা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেল। ভাগ্যচন্দ্র সৃষ্ট সুর-তাল-লয়ে বাঁধা সেই রাসলীলা এখন মণিপুরের অন্যতম সাংস্কৃতিক পরিচয়। রাসনৃত্যে পোশাক পরিকল্পনা থেকে যাবতীয় ভাবনা ছিল ভাগ্যচন্দ্রের, জানান নবদ্বীপের মণিপুর-গবেষক প্রবীর ভট্টাচার্য। পরবর্তী কালে রাসনৃত্যই মণিপুরের নিজস্ব নৃত্যশৈলীর প্রধান ধারা হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে মণিপুরের রাসনৃত্য নিয়ে আরও অনেক কাজ হয়েছে। তবে ভাগ্যচন্দ্র কৃত মণিপুরি রাসের উদ্ভব নিয়ে মতপার্থক্য আছে। সর্বাপেক্ষা সমর্থিত মতটি হল, ১৭৭৯ সালে ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে রাসনৃত্যের সৃষ্টি করেন। তাঁর মৃত্যুর প্রায় একশো বছর পর আর এক মণিপুররাজ চন্দ্রকীর্তির সময়ে রাসনৃত্যের কিছু সংস্কার হয়। তাঁর আমলে রাসনৃত্য ভঙ্গিমার বেশ কিছু রদবদল করা হয়।
রাজকুমার টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ বলেন “মণিপুর রাজবাড়িতে কবে থেকে রাসনৃত্যের সূচনা, তা ঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে অনুমহাপ্রভুর সামনে প্রাচীন নাটমন্দিরে কেবল রাসের সময় বলে নয়, যে কোনও উৎসবেই বিশুদ্ধ মণিপুরি আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয় রাসলীলা। এ জন্য মণিপুর থেকে তাবড় তাবড় শিল্পীরা চলে আসেন এই নবদ্বীপে।”
প্রবীর ভট্টাচার্য জানান, “পঞ্চাশের দশকে মণিপুরি রাসনৃত্যকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেন গুরু তরুণকুমার থিয়াম এবং তাঁর স্ত্রী বিলাসিনী দেবী। ভাগ্যচন্দ্রের রাস এঁদের হাতে অন্যমাত্রা পায়। সে সময় থেকেই নবদ্বীপে মণিপুরি রাসের জনপ্রিয়তা।” উল্লেখ্য তাঁরা নাট্যব্যক্তিত্ব রতন থিয়ামের বাবা-মা।