চরের বালি ঠেলে কাল মাধ্যমিকে

বাঘমারা হাইস্কুলের ছাত্রী মেরিনা বলে, ‘‘প্রায় চার কিলোমিটার বালির চর পেরিয়ে যেতে হয় স্কুলে। বর্ষায় ওই পথের বড় অংশটা যেতে হয় নৌকা করে। মাঝে বিএসএফের কাছে প্রমাণ দেওয়ার পালা। এখানে লেখাপড়া মানে তো একটা যুদ্ধ!’’

Advertisement

কল্লোল প্রামাণিক ও সুজাউদ্দিন

করিমপুর ও ডোমকল শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৮ ০৩:৩০
Share:

পরীক্ষার পড়া। চরমেঘনায়। নিজস্ব চিত্র

দুধসাদা ধু-ধু বালির চর।

Advertisement

সেই বালি তেতে ওঠার আগেই পৌঁছতে হবে নদীর ও পারে। মাঝে বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতার। এই চর সেই গণ্ডীর বাইরে। বেড়া পেরিয়ে তবেই দেশের মূল ভূখণ্ডে ঢোকা।

তাই বালি পার করলেই তো হবে না। টানা রোদে দাঁড়িয়ে জওয়ানদের সামনে নিজের ভারতীয়ত্বের প্রমাণ পেশ করতে হবে। তার পরে হেঁটে বা সাইকেলে মূল রাস্তায় গিয়ে ধরতে হবে গাড়ি। তবেই গিয়ে পৌঁছনো যাবে পরীক্ষাকেন্দ্র।

Advertisement

কাল, সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে মাধ্যমিক। মুর্শিদাবাদের চর পরাশপুর থেকে পরীক্ষা দিচ্ছে মাত্র এক জন— মেরিনা খাতুন। উচ্চ মাধ্যমিক দেবে তিন জন। বাঘমারা হাইস্কুলের ছাত্রী মেরিনা বলে, ‘‘প্রায় চার কিলোমিটার বালির চর পেরিয়ে যেতে হয় স্কুলে। বর্ষায় ওই পথের বড় অংশটা যেতে হয় নৌকা করে। মাঝে বিএসএফের কাছে প্রমাণ দেওয়ার পালা। এখানে লেখাপড়া মানে তো একটা যুদ্ধ!’’

চরে এখনও গড়ে ওঠেনি হাইস্কুল। ফলে ছাত্রছাত্রীদের আসতে হয় পদ্মাপাড়ের ঘোষপাড়া গ্রামে সবর্পল্লী বিদ্যাপীঠে। চরের বাসিন্দা, ঘোষপাড়া পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সদস্য জাব্দুল মণ্ডলের কথায়, ‘‘দুই চর মিলিয়ে এখন হাজারেরও বেশি পরিবারের বাস। কিন্তু বিদ্যুৎ, স্কুল বা রাস্তা কিছু নেই। ফলে আমাদের সন্তানদের যুদ্ধ করেই লেখাপড়া করতে হয়।’’

নদিয়ার চরমেঘনা থেকে কাঁটাতার পেরিয়ে এ বার মাধ্যমিক দিতে আসছে ন’জন। তিনটি ছাত্রী, ছ’টি ছাত্র। সকলেই হোগলবেড়িয়া আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের এবং পরিবারের প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। বিদ্যুৎ মণ্ডল, বিপাশা মণ্ডল বা রাধারানী মণ্ডলদের সাইকেলে আঠারো কিলোমিটার দূরে যমশেরপুর স্কুলে পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতে হবে। বাড়ি থেকে বেরোতে হবে সাতসকালে, ফিরতে সেই সন্ধে।

করিমপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন কর্মাধ্যক্ষ তথা গ্রামের বাসিন্দা উত্তম সর্দার জানান, সেখানে শ’দুয়েক পরিবারের সকলেই দিনমজুর। তার অর্ধেক সাক্ষর। সন্ধ্যায় সীমান্তের গেট বন্ধ হয়ে গেলে দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন। আগে বিদ্যুৎ বা রাস্তা কিছুই ছিল না। বছর ছয়েক আগে বিদ্যুৎ এসেছে। সম্প্রতি মেঘনা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তার অর্ধেক পাকা হয়েছে। সবেধন নীলমণি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

হোগলবেড়িয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিমলকৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, ‘‘অনেক কষ্ট করে ওরা পড়াশোনা চালায়। এই লড়াইকে কুর্নিশ করতেই হবে।’’ বিপাশার বাবা বুদ্ধদেব বলেন, “প্রায় আট কিলোমিটার দূরে স্কুলে যেতে হয়েছে এত দিন। লড়াইটা সহজ করতে ওরা অনেকেই এক বাড়িতে পড়াশোনা করেছে। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা দিতে চলেছে ওরা। চিন্তায় রয়েছেন গোটা গ্রামের মানুষ।”

কাল সকালে পড়শিরা অপেক্ষায় থাকবেন। প্রতি বারই এমনটা হত্যে দিয়ে থাকেন। ছেলেমেয়েগুলো বাড়ি থেকে বেরোলেই নাড়ু, মুড়কি বা বিস্কুট ব্যাগে গুঁজে দিতে হবে না? ওরাই তো ভবিষ্যৎ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন