রামতনু লাহিড়ীর শহরে বসবাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল

চলছিল ব্রাহ্মধর্মে গো-মাংস খাওয়ার অপপ্রচার

গোঁড়া হিন্দুসমাজ রামতনু লাহিড়ী, ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায়দের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সক্রিয় হল। আর সেটা করতে গিয়ে তারা আশ্রয় নিল নানান অপপ্রচারের। শুরু হলে সামাজিক নির্যাতন। যার হাত থেকে রেহাই পেলেন না নব্যদলের পরিবারও।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৮ ০৭:০০
Share:

অসংরক্ষিত: কৃষ্ণনগরে ব্রাহ্মসমাজের বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

কৃষ্ণনগরের শিক্ষিত সমাজের মধ্যে তখন রীতিমতো ব্রাহ্মসমাজের জোয়ার বইতে শুরু করেছে। শহরের বুকে ব্রাহ্মধর্মভাবাপন্ন মানুষদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একদিকে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের মতো সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। অন্যদিকে, ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ডিরোজিওর শিষ্য রামতনু লাহিড়ী-সহ বিভিন্ন শিক্ষিত ও মুক্তমনা মানুষের সংস্পর্শে এসে শহরে এক শ্রেণির নব্যদল তৈরি হতে থাকল। যাঁরা বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার, জাতিভেদের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করলেন।

Advertisement

সেই অর্থে কৃষ্ণনগর শহরকে ঘিরে যেন প্রকৃত অর্থেই শুরু হয়েছিল নবজাগরণ। এই নব নব্যদলের কর্মকাণ্ডে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকল গোঁড়া হিন্দুসমাজ। স্বাভাবিক ভাবেই তারা এঁদেরকে ভাল চোখে দেখল না। নব্যদলের নানা সংস্কারমুখী কার্যকলাপের বিরোধিতায় নামল রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দুসমাজ।

লেখক সুবীর সিংহরায় বলছেন, ‘‘স্বাভাবিক ভাবেই গোঁড়া হিন্দুরা এই ধরনের সংস্কারমূলক কাজকর্মকে মেনে নিতে পারলেন না। উলোর বামনদাস মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ তাঁদের চরম বিরোধিতায় নামল। নানা অপপ্রচাররের মাধ্যমে নব্যদলের বিরুদ্ধে শহরের মানুষকে খেপিয়ে তুলতে থাকল।’’

Advertisement

গোঁড়া হিন্দুসমাজ রামতনু লাহিড়ী, ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায়দের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সক্রিয় হল। আর সেটা করতে গিয়ে তারা আশ্রয় নিল নানান অপপ্রচারের। শুরু হলে সামাজিক নির্যাতন। যার হাত থেকে রেহাই পেলেন না নব্যদলের পরিবারও। শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণনগর শহর ছাড়তে হল বাংলার নবজাগরণের অন্যতম প্রাণপুরুষ রামতনু লাহিড়ীকে।

সেই সময়ে পরিস্থিতি কেমন গরম হয়ে উঠেছিল, তার বর্ণনা পাওয়া যায় দেওয়ান কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায়ের আত্মজীবন-চরিত থেকে। যিনি ছিলেন সেই সময়কার কৃষ্ণনগরের নব্যদলের অন্যতম সদস্য। তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে কী ভাবে সে দিন রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দুরা নানা অপপ্রচার করে এই নব্যদলকে কোণঠাসা করতে চায়।

কলকাতা থেকে এসেছেন কালীকৃষ্ণ মিত্র। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে নৌকায় করে আনন্দবাগে বনভোজনে গিয়েছিলেন কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায়, রামতনু লাহিড়ী, তাঁর দুই ভাই শ্রীপ্রসাদ লাহিড়ী, কালীচরণ লাহিড়ী, তাড়িণীচরণ রায়, বামাচরণ চৌধুরীরা। সেখানে নৌকার মধ্যে বিধবা বিবাহের প্রস্তাব গ্রহণ করা হল। সেই বনভোজন নিয়েও শহরের ভিতরে প্রচার করে দেওয়া হল, বনভোজনে গো-হত্যা ও গো-মাংস খাওয়ার কল্প-কাহিনি। শুরু হল সামাজিক নির্যাতন।

এরই মধ্যে কৃষ্ণনগর কলেজে একটি সভার আয়োজন করা হল। সেখানে উপস্থিত থাকল বেশির ভাগই স্কুল-কলেজের ছাত্রেরা। সেই সভায় নানা সামাজিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে নিন্দা করার পাশাপাশি বিধবা বিবাহ বাস্তবায়িত করার জন্য প্রতিজ্ঞা করা হল। এ ক্ষেত্রেও প্রচার করা হল যে, সেই সভায় গো-হত্যা করা হয়েছে। গো-মাংসের সঙ্গে মদ্যপানের কথা প্রচার করা হল।

এ ভাবে একের পর এক অপপ্রচারে ক্রমশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়তে থাকলেন কৃষ্ণনগরবাসী। একইসঙ্গে বাড়তে থাকল সামাজিক নির্যাতন। রামতনু লাহিড়ীর কৃষ্ণনগর শহরে বসবাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল। ১৮৫১ তিনি বাধ্য হলেন কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে বর্ধমানে বদলির আবেদন করতে। সেই মতো তিনি বদলিও হয়ে যান। গোঁড়া হিন্দুসমাজের একের পর এক অপপ্রচারে ধাক্কা খেতে থাকল ব্রাহ্মসমাজ। আন্দোলনও অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়তে থাকল।

এ সবের মধ্যে কৃষ্ণনগরে মুন্সেফ চণ্ডীচরণ রায়ের একটি রায়কে ঘিরে কৃষ্ণনগর শহরে ব্রাহ্মধর্মাবলাম্বীরা আবারও জোর ধাক্কা খেলেন। এই চণ্ডীচরণ রায় ছিলেন রামতনু লাহিড়ির বন্ধু। যিনি বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। বিধবার সম্পত্তি সংক্রান্ত একটি মামলায় রায় দিতে গিয়ে তিনি লিখলেন— হিন্দু বিধবাদের শতকরা নিরানব্বই জন অসতী। এই বক্তব্যকে ব্যঙ্গ করে লিখলেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। হাতে বড় অস্ত্র পেয়ে গেল রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ। বৃদ্ধি পেল ব্রাহ্ম-বিদ্বেষ। আরও অনেকটা কোণঠাসা হলেন কৃষ্ণনগরের ব্রাহ্মধর্মভাবাপন্ন মানুষেরা।

তার পরেও কৃষ্ণনগর শহরে ব্রাহ্মরা সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু নতুন করে আর তেমন কেউ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেননি। পাশাপাশি, গোটা বাংলার মতোই কৃষ্ণনগর শহরে ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলন স্থিমিত হয়ে পড়তে থাকে। যদিও ষাটের দশক পর্যন্ত কিছু ক্ষেত্রে তাদের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়।

স্থানীয় বাসিন্দা সঞ্জিত দত্ত বলছেন, “ষাটের দশক পর্যন্ত আমরা ব্রাহ্মমন্দিরে প্রার্থনা করতে দেখেছি। তার পর খালিই পড়ে থাকত। তবে ১৯৮৫ সাল নাগাদ একবার কলকাতা থেকে কয়েকজন ব্রাহ্ম এসে একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন। সেই শেষ।’’

পড়ে থেকে থেকে একসময় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় কৃষ্ণনগরের গৌরবময় যুগের শেষ চিহ্নটুকুও। কৃষ্ণনাগরিকদের স্মৃতি থেকে মুছে যেতে থাকে ব্রাহ্মসমাজ ও তাদের সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনের কথা। পুরসভার এই উদ্যোগকে তাই সাধুবাদ দিচ্ছেন অনেক কৃষ্ণনাগরিকই। কৃষ্ণনাগরিক লেখক স্বদেশ রায় বলছেন, ‘‘হারিয়ে যেতে বসা শহরের গৌরবময় যুগকে আমাদের সামনে আবার নতুন করে তুলে ধরল পুরসভা। তাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবে সবটাই অক্ষত রাখতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন