পৌষ-পার্বণ

পৌষবুড়ি করেই এক ছুটে ঘাটে

গোবর দিয়ে নিকানো চওড়া উঠোন। ঝকঝক তকতক করছে। এককোণে তুলসী মন্দিরের সামনে চালের গুঁড়োর বাহারি নকশা। অন্য দিকে ধুয়ে মুছে সিঁদুর মাখিয়ে রাখা ঢেঁকি। সেই ঢেঁকিঘরের সামনে থেকে পুরো উঠোন জুড়ে পিটুলির গোলা এক বিশেষ ধরনের গাছের আঠার সঙ্গে ঘন করে গুলে আঁকা হয়েছে চোখ ধাঁধানো আলপনা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:৫১
Share:

বেলপুকুরে পিঠের হেঁশেল।

গোবর দিয়ে নিকানো চওড়া উঠোন। ঝকঝক তকতক করছে। এককোণে তুলসী মন্দিরের সামনে চালের গুঁড়োর বাহারি নকশা।

Advertisement

অন্য দিকে ধুয়ে মুছে সিঁদুর মাখিয়ে রাখা ঢেঁকি। সেই ঢেঁকিঘরের সামনে থেকে পুরো উঠোন জুড়ে পিটুলির গোলা এক বিশেষ ধরনের গাছের আঠার সঙ্গে ঘন করে গুলে আঁকা হয়েছে চোখ ধাঁধানো আলপনা।

তুলসী মন্দিরের সামনে আঁকা হয়েছে ‘নেড়া নেড়ি’ (ভিন্ন মতে ‘বুড়োবুড়ি’)। সামনে থরে থরে সাজানো নানা রকম পুলিপিঠে, পাটিসাপটা। কত নাম— আস্কে পিঠে, গোকুল পিঠে, ভাজা পিঠে। চন্দ্রপুলি, ক্ষীরপুলি, দুধপুলি, আঁদোশা।

Advertisement

মকর সংক্রান্তির কাকভোরে উঠে বাড়ির সদর দরজার সামনে গোবর দিয়ে পৌষবুড়ি তৈরি করেই এক ছুট ঘাটে। গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী তখন শীত কুয়াশায় মাখামাখি। কনকনে সেই জলে কোনও রকমে তিন ডুব। হাড়ে কাঁপন ধরানো সেই ভোরে বাড়ি ফিরে পাটভাঙা শাড়িতে পৌষ আগলানো শুরু করতেন। পৌষবুড়ি মানে গোবরের গোলাকার পিণ্ডের উপর ধান, দূর্বা, ফুল, যবের শিস, সিঁদুর দিয়ে পুজো করে প্রার্থনা করতেন, “এসো পৌষ যেও না, জন্ম জন্ম ছেড়ো না।” কোথাও কোথাও সংক্রান্তির আগের সন্ধ্যায় পৌষ আগলানো হতো। গ্রামের বৌ-ঝি’রা গাইতেন, “পোষ মাস লক্ষী মাস না যাইও ছড়িয়া, ছেলেপিলেকে ভাত দেব খান্দা ভরিয়া।”

আশির কাছাকাছি পৌঁছেও ছবিগুলি এখনও স্পষ্ট দেখতে পান ওপার বাংলার কলাকোপা গ্রামের কনকপ্রভা দেবী। তাঁর কথায় “অঘ্রানে নতুন ধান উঠলেই প্রস্তুতি শুরু হত। ঢেঁকিতে নতুন চাল গুঁড়ো করা শুরু হল মানেই মকর পরব এসে গেল। আমাদের গ্রামে তিনদিন ধরে উৎসব হতো। উৎসব মানে চাল, দুধ, গুড় দিয়ে নানা রকম পিঠেপুলি তৈরি করে পাড়া-প্রতিবেশিদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া।” দেশভাগের পর নবদ্বীপে এসেও প্রথম দিকে পৌষ সংক্রান্তিতে সাধ্য মতো পিঠেপুলি বানিয়েছেন। এখন করেন না? উত্তরে ম্লান হেসে কনকপ্রভা বলেন, “ইচ্ছা তো করে। কিন্তু শরীর দেয় না।”

তবে বিরানব্বই বছরে পৌঁছেও সুধারানী ভৌমিক এখনও অক্লান্ত। সরু পায়ের উপর পরিষ্কার সাদা কাপড় বিছিয়ে এক মনে ‘চষির’ লেচি কাটছিলেন। পিঠের জন্য চষি বানানো খুব ঝামেলার কাজ। নতুন চালের গুঁড়ো ভাল করে ময়দার মতো মেখে নিতে হবে। তার পর নতুন কাপড় জলে ধুয়ে শুকিয়ে তার মাড় তুলে নরম করে তার উপর হাতে লেচি বেলতে হয়। সেই চষি দুধ এবং নতুন গুড়ের সঙ্গে ফুটিয়ে সারারাত ভিজিয়ে পরের দিন ছেঁকে তুলে নিয়ে, নতুন গুড়ের পায়েসে মধ্যে দিয়ে চষির পায়েস করার নিয়ম। এক দমে কথাগুলো বলে যেন হাঁফিয়ে উঠলেন ও-পার বাংলার সুধারানী। নবদ্বীপের প্রাচীন মায়াপুরের বাড়িতে বসে আরও কত পিঠের নাম বলে চলেন তিনি।

“যদিও পৌষপার্বণের প্রধান কিন্তু সরা পিঠে। উৎসবের তিন দিনই মাটির সরা পোড়াতে হয়। প্রথম দিন সরার ভিতরে ধানের তুঁষ রেখে পাট কাঠির আগুনে কিছু ক্ষণ পুড়িয়ে সরাকে ‘তৈরি’ করে নিতে হয়। নতুন চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় সরা পিঠে। প্রথমটি দেওয়া হয় গরুকে। তার পর অন্যদের,” বলছিলেন কৃষ্ণগঞ্জের প্রবীন বধূ আভা ঘোষ।

আবার জিয়াগঞ্জের ষাটোর্ধ্ব প্রদীপকুমার দাস পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বললেন, খুব ভোরে স্নান সেরে, পাটভাঙা কাঁচাধুতি পরে তিনি হাতে নিতেন পাথরের বাটি। সেই বাটিতে থাকত আতপ চালবাটা তরল। সেই তরলে তিনি সাদা কাপড় ভিজিয়ে গাছে, তুলসিতলায়, উঠোনে, ঘরের দেওয়ালে ঝোপ ঝোপ করে দাগিয়ে দিতেন। ময়মনসিংহ জেলার পৌষপার্বন বলতে প্রথমেই সেই বাল্যস্মৃতি আজও ভেসে আসে।

বিভা সাহার জন্ম রাজশাহী জেলার পানিকামরা গ্রামে। এখন বাস জিয়াগঞ্জে। তাঁর স্মৃতির সরণি প্রদীপবাবুর থেকে কিছুটা ভিন্ন। বললেন, ‘‘শৈশবে দেখেছি পৌষপার্বনে আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করা ছিল বাধ্যতামূলক। প্রতিবেশীদেরও ডাকা হতো। নয়তো তাঁদের বাড়িতে যেত থালা বোঝাই পিঠেপুলি।’’ বলে চলেন তিনি, ‘‘পাটিসাপটা, চন্দ্রকান্তা, মুগসামলি, গোকুল পিঠে, চন্দ্রপুলি, সরুচুকলি, ভাজাপিঠে, ভাপাপিঠে, রসপিঠে, আরও কত কী। কলাইডালের রসবড়ার স্বাদই ছিল আলাদা!’’

সাগরদিঘির বাসিন্দা সরস্বতীদেবী যেমন জানালেন, বয়সের ভারে এ বছর আর পিঠে বানাতে পারেননি। মেলা থেকে খান বিশেক পাটিসাপটা কিনেছিলেন। ‘‘কিন্তু মন আর ভরল কই। নাহ্‌, সে স্বাদ-গন্ধ... সে সব আর নেই!’’

(তথ্য সহায়তা: অনল আবেদিন ও দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য ও গৌতম প্রামাণিক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন