সংশয় ছিলই। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দিল, রানাঘাট-কাণ্ডের তদন্তভার নিচ্ছে না সিবিআই। শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর অধীনস্থ কর্মিবর্গ মন্ত্রকের তরফে রাজ্যের মুখ্যসচিবকে চিঠি দিয়ে এই কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও কী কারণে সিবিআই এই তদন্ত করছে না, চিঠিতে তার কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। সরকারি ভাবে কোনও কর্তাই কিছু ভেঙে বলতে চাননি।
১৩ মার্চ গভীর রাতে গাংনাপুরের মিশনারি স্কুলে এক বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণ ও ডাকাতির ঘটনার তদন্ত প্রথমে সিআইডি-র হাতে তুলে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পাঁচ দিনেও বিশেষ অগ্রগতি চোখে না পড়ায় ১৮ মার্চ নবান্নের তরফে দিল্লির কাছে চিঠি পাঠিয়ে সিবিআই তদন্তের আর্জি জানানো হয়। কর্মিবর্গ মন্ত্রকের তরফে তখনই ওই আবেদনে ‘পদ্ধতিগত ত্রুটি’র কথা রাজ্যকে জানানো হয়। সরকারি সূত্রের খবর, নবান্ন সেই অনুযায়ী ত্রুটি সংশোধন করে নতুন আবেদন জানানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে।
সেই নতুন আবেদন ফের দিল্লিতে পৌঁছনোর আগেই অবশ্য গত ১৯ মার্চ সিবিআইয়ের যুগ্ম অধিকর্তা নীনা সিংহের চিঠি আসে নবান্নে। যুগ্ম অধিকর্তা চিঠিতে জানান, তাঁরা তদন্তভার নিচ্ছেন। রাজ্যে সিবিআইয়ের দল পাঠানোর কথা জানিয়ে ওই অফিসারদের অস্থায়ী বাসস্থান ও কাজের পরিকাঠামোর বন্দোবস্ত করতে বলা হয় রাজ্যকে। রাজ্যের এক মুখপাত্র জানান, সিবিআইয়ের কথামতো এফআইআরের কপি-সহ মামলার কাগজপত্র তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এর পর সিবিআই আর উচ্চবাচ্য করেনি। বস্তুত, এর পর থেকেই সিবিআই নিয়ে সংশয় বাড়তে থাকে নবান্নে। যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হল শুক্রবার।
রাজ্য সরকারের আবেদন খারিজ করে কর্মিবর্গ ও প্রশিক্ষণ মন্ত্রকের চিঠি।
রাজ্যকে এ দিন পাঠানো চিঠিটিতে কর্মিবর্গ মন্ত্রকের আন্ডার সেক্রেটারি সুশীল কুমার লিখেছেন, রাজ্যের অনুরোধ বিবেচনা করা হয়েছে এবং সব দেখেশুনেই এই তদন্ত হাতে নেওয়া হচ্ছে না। সিবিআই অধিকর্তাকেও এই কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং চিঠিতে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষেই। কিন্তু প্রথমে রাজি হয়েও কেন হাত গুটিয়ে নিল সিবিআই, তার কোনও সদুত্তর মিলছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র কে এস ধাতওয়ালিয়া এ বিষয়ে কিছু ভেঙে বলতে নারাজ। তিনি শুধু বলেছেন, “আবেদন খতিয়ে দেখে ওই তদন্তের দায়িত্ব নেওয়া হবে না বলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
ঘনিষ্ঠ মহলে অবশ্য কেন্দ্র ও রাজ্যের শীর্ষ স্তরের আমলারা সিবিআইয়ের এ ভাবে হাত গুটিয়ে নেওয়ার বিভিন্ন ব্যাখ্যা করছেন। অনেকের মতে, রানাঘাট কাণ্ডের তদন্ত করতে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একাংশ প্রথম থেকেই অরাজি ছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, রানাঘাটের ঘটনাটি ডাকাতি ও ধর্ষণের। সিবিআই একটি বিশেষ তদন্তকারী সংস্থা, যারা আর্থিক দুর্নীতি বা বিশেষ ধরনের অপরাধের রহস্য ভেদ করতে কাজ করে। রানাঘাটের তদন্তভার নিলে ভবিষ্যতে যে কোনও রাজ্য সরকার নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে এই ধরনের ঘটনায় সিবিআইয়ের কোর্টেই বল ঠেলে দেবে। তা ছাড়া, সিবিআই বলে থাকে, তাদের লোকবল কম। রাজ্যগুলিও তদন্তে যথাযথ ভাবে অফিসার দিয়ে সাহায্য করে না বলে তাদের ক্ষোভ রয়েছে। সেটাও তাদের অপারগতার অন্যতম কারণ হতে পারে। যদিও রানাঘাটে সিবিআই-এর ‘না’ বলে দেওয়ার পিছনে ‘রাজনৈতিক কারণ’ও থাকতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
রানাঘাট তদন্তে প্রস্তুত, জানিয়ে সিবিআইয়ের প্রথম চিঠি।
আর এক অংশ আবার মনে করছেন, বৃহস্পতিবার সিআইডি দু’জনকে গ্রেফতার করার পর এখন আর সিবিআই তদন্তের প্রয়োজন নেই। কারণ, সিআইডি-র হাতেই দু’জন গ্রেফতার হওয়ার অর্থ, তারা প্রাথমিক ভাবে রহস্যভেদ করতে সক্ষম হয়েছে। ধৃত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বাকিদের নাম পাওয়া যাবে। তাঁদের মতে, এটি সাধারণ ‘ওপেন অ্যান্ড শাট’ কেস। এর মধ্যে আর বিশেষ মাথা খাটানোর কিছু নেই। সিবিআইয়ের পক্ষে এখন তদন্তে নেমে অতিরিক্ত কিছু করা সম্ভব নয়। তাই ওই গ্রেফতারির সংবাদ আসতেই রাজ্যের আর্জি নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
নবান্নের এক শীর্ষ কর্তার অবশ্য অভিযোগ, “রাজ্যে ক্ষমতা বদলের পর ১৪টি ঘটনার তদন্তভার সিবিআই-কে দেওয়া হয়েছিল। কোনওটাই ওরা করেনি। এতে বোঝা গেল, চাইলেই সিবিআই পাওয়া যায় না। তবে রাজ্য এ নিয়ে কেন্দ্রকে পাল্টা কোনও চিঠি দিচ্ছে না। তাঁর কথায়, “আমাদের সিআইডি তো ভালই কাজ করেছে।”
নবান্নের এক অফিসার জানান, ওই সবক’টি ঘটনাই ওয়াকফ সম্পর্কিত। এর বাইরে রানাঘাট-কাণ্ডের তদন্তে সিবিআই চেয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। সবই নাকচ হয়েছে। তবে আদালতের নির্দেশে ধনেখালি থানার পুলিশ হেফাজতে এক তৃণমূল কর্মীর মৃত্যুর ঘটনা এবং সারদা-কাণ্ডের তদন্তভার হাতে নিয়েছে সিবিআই।