রশি ধরে। নিজস্ব চিত্র
বৃষ্টি ধরে এলেও বানভাসি গ্রামে তখনও বাড়ির দাওয়ায় জল, রাস্তা এক হাত থইথই কাদার দখলে।
বছর দশেকের ছেলেটার নিরন্তর ঘ্যানঘ্যান তবুও থামে না— ‘বাবা রথ টানব তো!’
ছেলের মন রাখতে, সেই ভরা প্লাবনেও বাড়ির পিছনের বাঁশ ঝাড় থেকে কঞ্চি এনে যেমন তেমন একটা রথ গড়ে দিয়েছিলেন বাবা। জল কেটেই নিরাভরণ সে রথ ঘুরেছিল গ্রামের জল-হারা রাস্তায়। সতেরো বছর আগে, বাবার গড়ে দেওয়া সেই রথ সেজেগুজে এখন আনুলিয়ার রথের মেলা। জৌলুসহীন গ্রামটা এখন সেই মেলায় বুক বেঁধে সম্বৎসরের মজা খুঁজে নিচ্ছে।
আর আনুলিয়া ব্যানার্জি পাড়ার ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর কঞ্চি দিয়ে গড়া রথ সে দিন গ্রাম ঘুরেছিল, হ্যাঁ, দিব্যি মনে আছে তার সেই দুপুরের কথা। সাতাশ বছরের নটরাজ বলছেন, ‘‘তখন তো অত বোঝার বয়স ছিল না। ছোট ছেলে বলে বাবার খুব আদরের ছিলাম। তাই বাঁশের রথ ওই ভরা আষাঢ়েও তৈরি করে দিয়েছিলেন বাবা।’’
ছেলের সেই আবদারের কথা মনে আছে ভোলানাথেরও, ‘‘ছোট তো, বড্ড ঘ্যানঘ্যান করছিল, তাই ওর মুখে একটু হাসি দেখতে নিজেই একটা গড়ে দিয়েছিলাম।’’ কোনও দেবদেবী নেই,ফাঁকা রথ নিছক আনন্দ বয়ে এনে ছিল সে দিন। সেই রেশটা এখনও ধরে রেখেছে আনুলিয়া।
এখন সেই রথ বেশ বড়সড়। আশপাশের গ্রামে তার পরিচিতিও বেশ। সে দিনের বাঁশের সেই রথ এখন লোহার এক মানুষ উঁচু। গ্রামের ধারে, এ দিন ছোট মেলাও বসছে বছর কয়েক ধরে। বাড়ি থেকে সে রথে চেপে জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রা প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে রানাঘাট শহরের কোর্ট মোড়ে যায় ফি বছর। সেখান থেকে ফিরে আসে আবার সেই ওএনজিসি মাঠে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আদতে ওই মাঠের কোলেই নটরাজের মামার বাড়ি। সেখানে ন’দিন থাকার পরে ফিরে আসে সে।
ভোলানাথবাবুর লোহা-টিনের কারবার। বলছেন, “সে দিন ভাল একটা রথ কিনে দেওয়ার অবস্থা ছিল না আমার। তাই বাঁশ দিয়েই গড়ে দিয়েছিলাম। আজ আর সে দিন নেই। আমাদের লোহা ও টিনের শেড দিয়েই পনেরো ফুটের রথ গড়েছি আমরা।’’ ভোলানাথবাবুর বাড়িতে তৈরি হয়েছে মন্দিরও। সেখানেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা বছরভর থাকে। নিত্য পুজোও হয়। স্থানীয় বাসিন্দা প্রদীপকুমার পাল বলেন, “বহু মানুষের ভিড়। একটা মেলাও বসে। গ্রামের মুখে অন্তত একটা দিন হাসি দেখতে, বেশ লাগে।’’ আর, লাজুক মুখে নটরাজ বলেন, ‘‘ভাগ্যিস সে দিন আবদার ধরেছিলাম!’’