অসহায়তা: মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
সাদা ফ্লুরোসেন্ট বোর্ডে গভীর লাল রঙ, তাতে লেখা— ‘রোগী সহয়তা কেন্দ্র’। তবে, ভুল ভাঙাচ্ছে তার যৌক্তিকতা। কারণ আর কিছু নয়, মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগী সহায়তা কেন্দ্রে কোনও রোগী-সহায়ক নেই।
রোগী সহায়তা কেন্দ্রের পাশে ট্রলিতে শুয়ে কাতরাচ্ছেন রোগী। সদ্য অপারেশন হয়েছে পায়ে। তাঁর পরিবারের লোকজন ট্রলি ঠেলে এনে সহায়তা খুঁজছেন একটু। একে তাকে ধরে জানতে চাইছেন, এ বার কি করনীয়। তবে নিঝুম সহায়তা কেন্দ্রে তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর মতো, নাহ কেউ নেই।
মেডিক্যাল কলেজের এটাও এক চেনা ছবি। দীর্ঘক্ষণ ধরে যন্ত্রণায় কাতরানো রোগীর পরিবারের লোকজনের পাশে সেই সময়ে আবির্ভুত হল দু’টো মুখ। হাসপাতালে সবাই তাঁদের চেনে, পরিচিত দালাল।
পাক্কা চিকিৎসকের মতো মন দিয়ে সব শুনে তারা প্রথমে দর হাঁকল ‘‘শ’ পাঁচেশ পড়বে, রাজি!’’ দর শুনে ট্রলিতে শুয়েই সদ্য অপারেশন হওয়া রোগী সটান উঠে বসেন, ‘‘টাকা কি গাছে ফলে, গ্রামের লোকেদের খবর দাও তো! যা করার ওরাই এসে করবে।’’ ঝামেলা বুঝে এ বার চুপচাপ সরে পড়ল দুই দালাল।
দালাল সাম্রাজ্যে ছেয়ে যাওয়া মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে রোগী সহায়তা কেন্দ্রের কথাই ধরা যাক। কি নেই তার সামনে, মোটর বাইকের সারি, ঝাল মুড়িওয়ালা, জনা দুয়েক ঝিমিয়ে থাকা সিভিক ভলান্টিয়ার, সকলেই রয়েছেন, নেই শুধু কোন রোগী সহায়ক। অথচ, বছর দুয়েক আগেও ছবিটা এমন ছিল না।
এগারো বছর আগে এই হাসপাতালেই কিডনিতে পাথর হওয়ায় অস্ত্রোপচার হয়েছিল বিনয় প্রামাণিকের। খড়গ্রামের বিনয়বাবু বলছেন, ‘‘দালালরাজ তখনও
ছিল। তখন ভরা কংগ্রেস আমল। হাসপাতাল শাসন করত কংগ্রেসের পল্টু। তার বাহিনীর দাপটেই চলত হাসপাতাল। তবে, পল্টু গুপ্তের মধ্যে একটা ‘রবিনহুড’ গোছের ব্যাপার ছিল।’’ তিনি জানান, করিডরে পড়ে থেকে যন্ত্রণায় কাতরানোর সময়ে পল্টুর লোকজনই তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে জোর করে বেডে তুলে দিয়েছিল। বিনয় বলছেন, ‘‘কই একটা পয়সাও তো দাবি করেনি।’’
তবে, ওই মেডিক্যাল কলেজের এক পুরনো চিকিৎসক বলছেন, ‘‘দালাল-রাজ পল্টুও চালাত। এখনও সেই ট্রাডিশন চলছে। তবে সে সময়ে দালালির পাশাপাশি তারা দুঃস্থ মানুষজনকে সেবা যত্নও করত, ওষুধ পথ্যও এনে দিত। এখন শুধু টাকার খাঁই, পাল্লা দিয়ে লোক ঠকানো।’’
হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির এক পুরনো সদস্য সেই পুরনো আর নয়া আমলের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘‘সে আমলে রোগীদের পাশে দাঁড়াতে কংগ্রেস এবং সিপিএমের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা চলত। পালাবদলের পরে এখন তো সকলেই শাসক দলের আশ্রয়ে থাকা দালাল। তাদের মধ্যে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। যা আছে তা টাকা তোলার কম্পিটিশন!’’