ফের কি ফিরব, জানেন না জব্বাররা

এলাকায় নেই কর্মসংস্থান। ফলে রুজির টানে ভিন্ রাজ্যে কাজের সন্ধানে পাড়ি দেন এলাকার যুবকেরা।

Advertisement

মফিদুল ইসলাম  

নওদা শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২০ ০১:৫৫
Share:

এ বার কী? ঘরের ছেলেরা ফেরার পরে তাঁদের কাছ থেকে দিল্লির হিংসার অভিজ্ঞতা শোনার পরে নেহারি এখন সেই আলোচনাতেই ব্যস্ত। নিজস্ব চিত্র

কোন পথে যাবে এখন নেহারিতলা?

Advertisement

সদ্য গ্রামে ফিরেছেন দিল্লির হিংসা কবলিত জাফরাবাদ এলাকায় আটকে পড়া তেরো জন শ্রমিক। ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরেছে, ফলে স্বভাবতই খুশি শ্রমিকদের পরিজনেরা। আর মৃত্যুর মুখ থেকে প্রাণ নিয়ে ঘরে ফিরতে পেরে খুশি শ্রমিকেরাও। তবে এলাকায় তারা কী কাজ করবেন? সংসার কিভাবে চলবে? ঘরে ফিরেই সেই চিন্তা তাড়া করে বেড়াচ্ছে দিল্লিতে আটকে পড়া শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের লোকেদের মনে।

এলাকায় নেই কর্মসংস্থান। ফলে রুজির টানে ভিন্ রাজ্যে কাজের সন্ধানে পাড়ি দেন এলাকার যুবকেরা। নওদার প্রত্যন্ত গ্রাম ত্রিমোহিনী নেহারিতলা গ্রামের অধিকাংশ যুবক ভিন্ রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেন। বেশিরভাগ যুবক বেঙ্গালুরুতে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করলেও প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ জন যুবক দিল্লির জাফরাবাদ সংলগ্ন মৌজপুর, গন্ডাচক, নুরিনা এলাকায় ইলেকট্রিক ফ্যানের কনডেন্সার তৈরির কাজ করেন। আর ভিন্ রাজ্যে কাজ করেই কেউ তৈরি করেছেন পাকা বাড়ি, কেউ বাবাকে কিনে দিয়েছেন চাষের জমি, কেউ বা বোনেদের বিয়ে দিয়েছেন, কেউ আবার ভাই বোনেদের লেখা পড়া শেখাচ্ছেন।

Advertisement

সেই রোজগান না থাকলে চলবে কী করে?

শনিবার সকালে পাড়ার চায়ের দোকানের মাচায় বসে গ্রামের বাসিন্দারা শুনলেন মহম্মদ কালাম, জব্বার শেখদের সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা। তার মাঝেই কথা উঠল এরপর কী?

নেহারিতলার বাসিন্দা দিল্লিতে আটকে পড়া শ্রমিক মহম্মদ কালাম এ দিন বলেন, ‘‘এলাকায় কাজ নেই তাই ভিটেমাটি পরিজনদের ছেড়ে ভিন্ রাজ্যে পড়ে থাকি। এখনও এক বোনের বিয়ে দিতে বাকি। সে বিএ সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। তার খরচ যোগাবো কী করে?’’

গ্রামের জমিতে পেঁয়াজ লাগিয়েছিলেন কালাম। কিন্তু তাতে রোজগার যথেষ্ট নয়। তাই ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিলেন তিনি।

ইমামুল শেখ, হালিম শেখ, আলমগির শেখরাও তাই করেন। অনেক যুবক খেতের সমস্ত কাজ বা রাজমিস্ত্রির কাজ করতে পারেন না। এলাকায় বিকল্প কাজের সুযোগ না থাকায় অনেকেই বছরের বেশিরভাগ সময় ভিন্ রাজ্যেই শ্রমিকের কাজ করেন। ইদ পরবের আগে বাড়ি ফিরে ঘরবাড়ির কাজ করেন। কিন্তু কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কখনও অন্য কোনও সমস্যায় আটকে পড়েন তাঁরা। নেহারিতলার বাসিন্দা দিল্লিতে রমজান শেখ দিল্লিতে আটকে পড়েছিলেন। তিনি বলছেন, ‘‘এর আগের বার বাড়ি ফিরে দু’কামরা ঘর ঢালাই করে গিয়েছিলাম। ইদের আগে এসে বেশ কিছু দিন থেকে ঘর প্লাস্টার, রং করাব বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু তা আর হল কই?’’ রমজানের মা খুরশিনা বিবিও বলছেন, ‘‘ছেলে বাইরে কাজ করত বলে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হয়েছিল।’’ রমজানের বাবা ইছানবি সেখ বলেন, ‘‘এলাকায় সারা বছর কাজ জোটে না। আর যা রোজগার হয় তা পেটে দিতেই ফুরিয়ে যায়।’’

গ্রামের বেশিরভাগ যুবক ভিন রাজ্যে কাজ করে পাকা বাড়ি তৈরি করছে। নিজেদের টালির ঘরে পাকা ছাদ হবে সেই আশা নিয়ে এলাকার যুবকদের সাথে দিল্লির কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতে গিয়েছিলেন আওলাদ সেখ ও হালিম সেখ নামে দুই ভাই। ইদের ছুটিতে এসে পাকা ঘর ধরার কথা।

কিন্তু সে আর হল না। আওলাদ, হালিমের মা আরফাতন বিবি বলেন, ‘‘আমি বেঁচে থাকতে হয়তো আর পাকা ঘর হবে না। তবে দুই ছেলে ঘরে ফিরেছে এই অনেক।’’

দিল্লিতে আটকে পড়া শ্রমিক আলমগির শেখ অবশ্য বলেন, ‘‘যত দিন দেশ শান্ত না হচ্ছে, না খেতে পেয়ে মরব তবুও আর ওখানে কাজে যাব না।’’ কিন্তু মিকারুল শেখ বলেন, ‘‘এখন কী কাজ করব, আর খাবই বা কী?’’

জনপ্রতিনিধিদের তরফে দিল্লিতে আটকে পড়া শ্রমিকদের এলাকায় কাজের বন্দোবস্ত করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তবে তারা কী কাজ পাবেন, আদতে কত দিন কাজ পাবেন তা নিয়েও ধন্দে শ্রমিকেরা। তা ছাড়া শ্রমিকেরা ভিন্ রাজ্যে কাজ করে, ওভারটাইম মিলিয়ে প্রতিমাসে বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা রোজগার করেন। এলাকায় কাজ করে আদতে তাদের পোষাবে কী?

পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতির তত্ত্বাবধানে নারেগা প্রকল্পে বছরে একশো দিনের কাজ পাওয়া যায়। যদিও জবকার্ড থাকলেই এই কাজ পাওয়া যায়।

সবাই একশো কাজ পাবেন তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। শ্রমিকদের দু একজন ছাড়া বাকিদের জবকার্ডও নেই। ফলে তাঁরা কেমন করে কাজ পাবেন? নওদা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘‘তাদের প্রত্যেকের যাতে জবকার্ড হয়, এবং তাঁরা একশো দিনের কাজ পান, পঞ্চায়েত সমিতির তরফে তার বন্দোবস্ত করা হবে।’’ নওদার জয়েন্ট বিডিও তপন কুমার দত্ত বলেন, ‘‘তারা যাতে একশো দিনের কাজ পান তার ব্যবস্থা করা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন