পাওয়া, না পাওয়ার ইদ

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

হরিহরপাড়া ও বহরমপুর শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৯ ০২:২৮
Share:

মগ্ন: বহরমপুরের খাগড়া বড় মসজিদে। সোমবার। ছবি: ইন্দ্রাশিস বাগচী

ইদগাহের মাঠে নমাজের সারিতে দাঁড়িয়ে এলাকার সর্বস্তরের মানুষ। তখনও নমাজ শুরু হয়নি। আচমকা সেখানে গিয়ে হাজির হরিহরপাড়া থানার ওসি আব্দুস সালাম শেখ। ইদগাহে দাঁড়িয়ে তিনি এলাকায় ‘সম্প্রীতি’ বজায় রাখার সঙ্গে ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ নিয়ে সচেতনতার বার্তা দিলেন। মাইকে হাতে তিনি বার্তা দিলেন, ‘‘ইদের দিন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়ার ব্যাপার থাকে। তবে বাড়ির অল্পবয়সীদের হাতে মোটরবাইক দেবেন না। বেপরোয়া ভাবে মোটরবাইক চালাবেন না। হেলমেট পরে এবং ট্রাফিক আইন মেনে মোটরবাইক চালাবেন।’’

Advertisement

সোমবার ছিল ইদুজ্জোহা। এ দিন হরিহরপাড়া থানার ওসি এলাকার বিভিন্ন ইদগাহে গিয়ে এলাকার মানুষকে ওই বার্তা দেন। তার পিছনে কারণও আছে বলে জানালেন চোঁয়া ইদ কমিটির সদস্য নিয়ামত শেখ। তিনি বলেন, ‘‘গত ইদে এলাকায় বেশ কয়েকটি মোটরবাইক দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এ বছর তার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, তাই ওসি সচেতন করলেন।’’

এ দিন ইদগাহে পৌঁছে ইমাম মুফতি জার্জিস হোসেন ও ইদ কমিটির সদস্যদের হাতে ফুল, মিষ্টি তুলে দিয়ে শুভেচ্ছা জানান ওসি। ওসি আব্দুস সালাম শেখ বলেন, ‘‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। আপনার আনন্দ অপরের নিরানন্দের কারণ হয়ে না দাঁড়ায় দেখা উচিত সকলের।’’

Advertisement

তবে জীবিকার তাড়নায় নবাবের জেলায় ইদের আনন্দ ও বিষণ্ণতায় দ্বিখণ্ডিত সেই বাড়ির উৎসব। এ বারও সকালে উঠে ইদুজ্জোহার স্নান ছিল। চোখে সুরমা-কাজল ছিল। হাতে মেহেন্দি ছিল। পরনে নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি-আচকান ছিল। মাথায় টুপি ছিল। কানে আতরে ভেজা তুলো গোঁজা ছিল। রান্নঘর থেকে ভেসে আসা সেমুই-লুচির সুবাস ছিল। উনুন থেকে রেয়াজি খাসির মাংস রান্নার ভেসে আসা খুশবু ছিল। তবু লালগোলার মাকসুদা বিবির ইদ ছিল না সোমবার। আবার ছিলও বটে।

বছর তিনেক হল তাঁর স্বামী হায়দার শেখ মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছেন। গাড়ির চালক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। স্ত্রী-সন্তানদের পদ্মাপাড়ের লালগোলায় রেখে মরুদেশে পাড়ি দিয়ে গাড়ির চালকের বদলে তিনি পেয়েছেন ২৫ হাজার টাকার মাস মাইনের রাজপথ ঝাড়ু দেওয়ার কাজ। তাতে বেশি দুঃখ তিনি পাননি। চার বছরের আগে তিন মরুদেশ ছাড়তে পারবেন না। ওই চুক্তি তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে মুষড়ে দিয়েছে।

ওই দুঃখের মধ্যেও প্রতিটি ইদ ঘিরে দু’দিন তাঁদের পরিবারে এক চিলতে খুশি উপচে পড়ে। এ বারেও তাই হয়েছে। আরব মুলুকে ইদ হয় এ দেশের তিন দিন আগে। লালগোলার মুর্শিদা বিবি বলেন, ‘‘গত শনিবার ওই দেশে ইদ হয়েছে। সে দিন স্বামী মোবাইলে ‘ইদ মোবারক’ পাঠিয়েছে। আর আজ আমাদের দেশের ইদের দিনে আরও এক বার ইদ মুবারক দিয়েছে। সামনে ডিসেম্বর মাসে স্বামী ঘরে ফিরবেন। সে দিন হবে আমাদের আসল ইদ।’’

এ জেলায় কয়েক হাজার মাকসুদা থাকলেও ইদের দিনে সবার দশা এক নয়। কর্মস্থল— কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, দিল্লি থেকে এক বছর, ছ’ মাস পর বাড়ি ফিরে সপরিবার আনন্দে ভাসছেন অনেকে। সামনের পক্ষকাল জুড়ে তাঁদের বিনোদনের তালিকায় আছে সিনেমা দেখা, হাজারদুয়ারি প্রাসাদ ও সংগ্রহশালা দেখা, প্রকৃতি তীর্থ-মতিঝিল ঘোরা, আত্মীয়পরিজনের বাড়ি যাওয়া। নতুন সংযোজন ধর্মীয় জালসা সংগঠিত করা।

রাজমিস্ত্রিদের ইদের ‘ছুটি’র অবসরে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাঁরা সম্পন্ন করেন। ইদ-উল-আজহা (ইদুজ্জোহা) উপলক্ষে বাড়ি ফিরে অনেক তরুণ বিয়ে করেন। অনেক কিশোরীর বিয়ে দেন ‘বিদেশ’-এ থাকা তাঁদের বাবা-দাদারা।

ইমাম ও মোয়াজ্জিন অ্যাসোসিয়েশনের লালগোলা ব্লকের সম্পাদক মওলানা জামসেদ আলি বলেন, ‘‘সারা বছরে যা বিয়ে হয় এই ব্লকে তার দ্বিগুণ বিয়ে হয় কোরবানির ইদের পরের পনেরো দিনের মধ্যে।’’ ইদের ‘ছুটি’ ছাড়াও আরও একটি কারণ আছে। কোরবানির মাংসে বিয়ের ভোজের খরচের একটা অংশ উসুল করা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন