লোকনাথ রায়। ফাইল চিত্র
খবরটা রটতে বেশি সময় লাগেনি বেশি। মুহূর্তে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল গোটা হাসপাতাল। ছিন্ন হল টানা ১৫ বছরের আত্মীয়তা। চোখের জলে লোকনাথ রায়কে বিদায় দিলেন চিকিৎসক থেকে সাফাইকর্মী।
১৫ বছর আগে কারা যেন তাঁকে রেখে গিয়েছিল হাসপাতালে। সেই থেকে পরিজন বলতে শান্তিপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীরা। এত বছর ধরে ৮৫ বছরের ‘শিশু’ আগলে রেখেছিলেন তারা। তাই মানুষটার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরে অনেকেই মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। হাসপাতালের সুপার জয়ন্ত বিশ্বাস এ দিন বলেন, “সকলেরই মন খারাপ। তাঁর বেডটা খাঁ খাঁ করছে। তাকানো যাচ্ছে না ও দিকে।” কবে থেকে যে হাসপাতলের আইসোলেশন ওয়ার্ডের এক কোনের বেডটি তাঁর স্থায়ী ঠিকানা হয়ে উঠেছিল, তা মনে করতে পারেন না কেউ। বৃদ্ধ লোকনাথ রায় নিজের ঠিকানাটা ঠিক করে বলে উঠতে পারেননি কোনও দিন। প্রথম দিকে বলেছিলেন শান্তিপুরের বাইগাছি। কিন্তু সেখানে খোঁজ নিয়ে কিছু পাওয়া যায়নি। ঠিকানা না মিললেও অসুস্থ মানুষটাকে ঠাঁইচ্যুত করেনি হাসপাতাল। সেই থেকে তিনি শান্তিপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালের বাসিন্দা হয়ে যান।
প্রথম থেকেই মানুষটার শরীর ছিল অত্যন্ত দুর্বল। মানসিক ভারসাম্যহীন না হলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক ছিলেন না কোনও দিনই। ক্রমশ দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়েছে। পেশির সমস্যার কারণে ভাল করে দাঁড়াতেও পারতেন না। হাসপাতালের কর্মীরাই মাঝে মঝ্যে কেটে দিতেন চুল-দাঁড়ি।
হাসপাতালের খাবার বরাদ্দ থাকলেও কর্মীরা বাড়ি থেকে আনা খাবার তাঁর সঙ্গে ভাগ করে নিতেন। পরব-পার্বনে নতুন জামা, শীতে গরম চাদর— হাসপাতালের ওম তাঁকে এ ভাবেই আপন করে নিয়েছিল। চিকিৎসক তাঁকে ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞাসা করলে, শিশুর মত মাথা নাড়তেন মানুষটা। ফোকলা দাঁতে এক গাল হেসে বলতেন,“ভাল। তুমি?”
২৪ বছর ধরে এই হাসপাতালে রয়েছেন চিকিৎসক শিবাজী কর। বিষণ্ণ শিবাজী বলেন, “এতগুলো বছর ধরে দেখেছি মানুষটাকে। একটা ভালবাসা তো তৈরি হয়েই যায়।” দুপুর গড়াতে তার দেহ কাঁচের গাড়িতে করে নিয়ে শ্মশানের দিকে এগোলেন কর্মীরা। তাঁর বেডে নতুন চাদর পড়ল।