মেলায় লোকের ঢল নেমেছে। ছবি:নিজস্ব চিত্র।
উত্তুরে হাওয়া টইটম্বুর পদ্মা ছুঁয়ে এসে কাঁপিয়ে দিচ্ছে চরাচর। সুতির বাজিতপুরে পদ্মার পাড়ে এসে থামলেন গৌরকান্তি দীর্ঘদেহী যুবক। গন্তব্য গৌড়। তার আগে দুপুরে পদ্মায় স্নান সেরে নিলেন। খবর পেয়ে ততক্ষণে ভিড় জমালেন গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁরা যুবককে একটি রাত থেকে যেতে অনুরোধ করলেন। করবেন নাই বা কেন। তিনি যে নদের নিমাই— শ্রী চৈতন্যদেব। সালটা ছিল ১৫৩০। দিনটা ছিল মাঘ মাসের প্রথম রবিবার।
সেই পূণ্য তিথিকে স্মরণ করে ১৫৯৬ সালে মাঘের প্রথম রবিবারে মেলা শুরু হয় পদ্মার তীরে। তবে, সে দিনের পদ্মা এখন অতীত। জলশূণ্য পদ্মা এখন ধু-ধু বালির চর। মহাপ্রভু যেহেতু এক দিন অধিষ্ঠান করেছিলেন, তাই মেলাও এক দিনের। বছর তিরিশেক আগেও এই মেলা এ-পার ও-পার একাকার হত। বিএসএফ-এর কড়াকড়িতে দাঁড়ি পড়েছে তাতে। এখন মেলার মাঠে বিএসএফ-এর নজর মিনার। তবে এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ফাঁক-ফোঁকর গলে বাংলাদেশ থেকেও কেউ কেউ আসেন এই মেলায়।
ক্রমে গ্রামে বলরাম, সর্বেশ্বর ও মদনমোহনের মন্দির হয়েছে। তিন দেবতার ভোগও বড় অদ্ভুত। মান কচু কেটে শুকনো করে গুঁড়ো করা হয়। তাই এ দিন নিবেদন করা হয় দেবতাকে। সকালের পুজোর পরেই শুরু হয়ে যায় মেলা। চলে প্রায় রাতভর। শুধু মুর্শিদাবাদই নয় এই মেলায় ভিড় করেন লাগোয়া বীরভূম, মালদহ, ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দারাও। স্থানীয়রা তো বটেই, বিএসএফ-ও বলছে, গত ১০ বছরে এ বারের মতো ভিড় হয়নি।
হোক না এক দিনের মেলা। তবে বিকিকিনি নেহাত কম হয় না। কী নেই এই মেলায়? গেরস্থালির জিনিসপত্র থেকে খাট-বিছানা, মাছ ধরার জাল থেকে সস্তার টিভি-মোবাইল পর্যন্ত, সবই হাজির।
অরঙ্গাবাদের জলিল সেখ মেলার অপেক্ষাতেই ছিলেন। বিড়ির বকেয়া হপ্তার মোটা টাকা পেয়ে চার হাজার ২০০ টাকা দিয়ে কিনেছেন একটি কাঠের খাট। বলছেন, “শীতের মেঝে যেন শরীরে ছোবল দেয়। তাই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে একটা পোক্ত দেখে খাট কিনেই ফেললাম।”
সকাল থেকেই মেলার মাঠের এক কিমি দূর থেকেই গাড়ির লম্বা লাইন। বেলা বাড়তেই গাড়ির লাইনও বেড়েছে। আগে নদীর তীরেই বসত দোকানপাট। এখন নিয়ন আলোর নিচে শুখা চরেও পসরার সারি। স্থানীয়রা জানালেন, এই মেলায় কোনও জাতি ভেদ নেই। ভিড় করেন সব ধর্মের মানুষ। মেলার মাঠ থেকে ও-পার বাংলা মিনিট কুড়ির হাঁটা পথ।
গাড়ি নিয়ে সপরিবারে সিউড়ি থেকে নেহাতই বেড়াতে এসেছিলেন সনাতন বাগচি। প্রত্যন্ত গ্রামের মেলায় ভিড় দেখে হতবাক তিনি। বললেন, “মেলা নয়, নেহাতই বেড়াতেই এসেছিলাম। সীমান্তের প্রত্যন্ত এই মেলায় এত ভিড় হবে ভাবিনি। শীতের পদ্মায় ধু ধু বালির চরেও মানুষের ঢল সত্যিই অবাক করার মতো। মাঝ রাতেও চলছে কেনা-কাটা।”