তোরণে এক প্রান্তের খুঁটি থেকে অন্য প্রান্তের খুঁটি পর্যন্ত টানটান করে বাঁধা মেয়েদের মাথায় বাঁধার কমলা রঙের নতুন ফিতে। পাশে একটি টেবিলের উপর ঝকঝকে কাঁসার বড় থালা। থালায় রয়েছে ফুল, কাঁচি ও পাঁচটি কাচের গ্লাস ভর্তি সরবত। বসন্তের ধুলো ওড়া পথের পাশের টেবিলে রাখা সরবতের গ্লাস চিনেমাটির প্লেট দিয়ে ঢাকা। পাশে খানচারেক চেয়ার। কনেবাড়ির কিশোরের দল সারারাত জেগে বিয়েবাড়ির সামনে আমপাতা দিয়ে তৈরি করেছে চামচিকে। রঙিন কাগজ কেটে ‘চেন’, বাঁশ ও দেবদারু গাছের পাতা দিয়ে সুসজ্জিত তোরণ তৈরি করেছে। ঘুমে ঢুলুঢুল চোখ তুলে তারা তাকিয়ে আছে বর আসার অপেক্ষায়।
গ্রামের রাস্তায় গরুর গাড়ির কনভয়ের মাইক থেকে ভেসে আসছে কলের গান, ‘বলি ও ননদি আর দু’ মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে/ ঠাকুরজামাই এল বাড়িতে...।’ গান শুনে কিশোরদের আধবোজা চোখ থেকে ঘুম উধাও। তাদের তখন ‘সাবধান! বিশ্রাম!’ দশা। বরপক্ষের সঙ্গে দর কষাকষি করে তোরণের ফিতে কাটার জন্য বরের কাছে থেকে সেলামি আদায় করতে হবে! বরপক্ষকে বোকা বানাতেও হবে। টানটান উত্তেজনায় খুদেরা বুকে বল সঞ্চয় করছে। কনেপক্ষের বড়রাও দর কষাকষির মশকরা দেখতে হাজির। তাঁরা অবশ্য এখানে নীরব দর্শক মাত্র।
তোরণের সামনে পালকিতে বসে আছেন বর ও নিতবর। জনা চারেক বরযাত্রী বসলেন তোরণের পাশের চেয়ারে। তাঁদের হাতে সাদরে ছোটরা তুলে দিল সরবত। মুখ চাওয়াচাওয়ি করে এক জন চুমুক দিয়েই মাটিতে সরবত ফেলে দিয়ে বলেন, ‘‘নুনে জহর!’’ অন্য জনের বিরক্তি, ‘‘সরবত নয়। লঙ্কাগোলা জল।’’ বরপক্ষকে ঠকিয়ে কনেপক্ষ হাসে। অপদস্থ বরপক্ষের মুখভার। লাখ কথা খরচের পর সেলামি পায় ছোটরা। ফিতে কেটে বর ও বরযাত্রী হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।
সতর্ক না থাকলে ছাদনাতলায় আর এক দফা বোকা বনতে হয় বাবাজীবনকে। ছাদনাতলায় কাঠের পিঁড়ি পাতা রয়েছে। এ বার বিয়ের মাঙ্গলিক আচার পালন করা হবে। লোকসংস্কৃতি গবেষক দীপক বিশ্বাস বলেন, ‘‘পিঁড়ির তলায় রাখা থাকত ৬-৭টি মার্বেল (টিপ্পি)। বর বসতেই গড়িয়ে পড়ল পিঁড়ি। বরের বেসামাল দশা দেখে কনেপক্ষ হেসে অস্থির। ছাদনাতলায় ৪০-৫০ বছর আগে এই রকম হাস্যরসের ঘটনা ঘটত।’’
শোলা দিয়ে তৈরি ভাত খেতে দেওয়া হয়েছে। শ্যালিকারা হাতপাখা দিয়ে বরকে বাতাস করতে শুরু করেন। দীপক বলেন, ‘‘শোলা কেটে তৈরি ভাত উড়ে গেল। বোকা বরের সামনে পড়ে থাকল শূন্য থালা। এ সব আমার মায়ের আমলের ঘটনা।’’ বাসরঘরে ঢুকে গিয়েছেন কনে। বাইরে দাঁড়িয়ে বর। কপাট বন্ধ। ঘোমটা টেনে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক মহিলা। হুকুম হল, ‘‘অবগুণ্ঠিতা তোমার পিসশাশুড়ি। প্রণাম করো!’’ প্রণাম করতেই ঘোমটা খুলে বেরিয়ে এল বরের শ্যালিকার মুখ।
অনেক কথার পর ঘরধরানির সেলামি ধার্য হল এক হাজার টাকা। বর বলেন, ‘‘টাকা নয়। মোহর দেব।’’ অতি উৎসাহী কনেপক্ষ রাজি। মেয়েপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয় কারুকাজ করা ভেলভেটের একটি ভারি থলে। বাসরঘরে ঢুকলেন বর। খিল দেওয়া দরজার সামনে বসে থলে উজাড় করে বোকা বনে যান কনের বান্ধবীরা। মোহরের বদলে পিতলের গাদা গুচ্ছের এক পয়সায় ভরা সেই থলে। গুনতেই রাত কাবার!