উদ্ধার হওয়া সেই মূর্তি। অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
কোটি টাকায় একটি কালো পাথরের বিষ্ণু মূর্তি কেনার লোভ দেখিয়ে প্রত্নসামগ্রী পাচারের ৫ জনের একটি দলকে সোমবার দুপুরে হাতে নাতে ধরল মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ থানার পুলিশ।
ওই থানারই জরুর পঞ্চায়েতের রমজানপুর গ্রামের জামিরুল শেখের বাড়িতে ওই মূর্তিটি নিয়ে এসেছিল সাগরদিঘির গৌরীপুর থেকে তৌসিফ জামাল ও ইমাজুদ্দিন সেখ। সেখানেই হাজির ছিল জামিরুলের বন্ধু মতিউর রহমান ও সুতির সালাউদ্দিন আনসারি। জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর জানান, তাঁদের কাছে খবর ছিল, একটি প্রাচীন মূর্তি বিক্রির চেষ্টা করছে রমজানপুরের জামিরুল ও মতিউর। সেই সূত্রেই রঘুনাথগঞ্জ থানার পুলিশের দুই কর্মী পরিচয় গোপন রেখে তাদের সঙ্গে মূর্তি কেনা নিয়ে কথাবার্তা শুরু করে। দু’ফুট উচ্চতার সেই মূর্তিটির ছবিও দেখানো হয় তাদের। ১০ লক্ষ থেকে বাড়তে বাড়তে শেষ পর্যন্ত এক কোটি টাকায় দাম রফা হয়।
সোমবার দুপুরে জামিরুলের বাড়িতে সেই মূর্তিটি আনার জন্যই যান সাদা পোশাকের পুলিশ কর্মীরা। সেখানে মূর্তিটি দেখা শোনা হতেই আরও পুলিশকর্মীরা ঢুকে পড়েন ঘরের মধ্যে। সে সময়ে রীতিমতো হাতাহাতিও হয় পুলিশের সঙ্গে মূর্তি পাচারকারীদের। তারপরই ওই ৫ জনকে আটক করে রঘুনাথগঞ্জ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ধৃতরা জানিয়েছে, গৌরীপুর এলাকায় এক ব্যক্তির কাছ থেকে তারা মূর্তিটি পেয়েছে। কষ্টি পাথরের মূর্তি ভেবেই তার চড়া দাম পাওয়ার আশায় তা বিক্রির চেষ্টা করছিল। জামিরুলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে গরু পাচারের অভিযোগ রয়েছে। সে-ই কথা দিয়েছিল, চড়া দামে মূর্তিটি বিক্রি করে দেবে। ধৃতরা এর আগেও প্রত্ন সামগ্রী বেচাকেনা করেছিল কি না, তা-ও অবশ্য খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের অধ্যাপিকা সুদীপা রায় বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, মূর্তিটি একাদশ শতকের। তিনি বলেন, ‘‘পাল-সেন যুগের মূর্তি নির্মাণ রীতি এখানে দেখা যাচ্ছে।’’ দু’ফুট উচ্চতার কালো পাথরের এই মূর্তিটির মাথার উপরে সিংহের মুখ। দু’পাশে দুই চামরধারিণী। দণ্ডায়মান বিষ্ণু মূর্তিটি মূর্তি নির্মাণ শিল্প রীতি অনুযায়ী কেশব। মূর্তিটির পায়ের কাছে বাংলা অক্ষরে ‘কেসব’ কথাটি লেখাও রয়েছে। তবে লেখাটি অনেক পরের সময়ের।
যে এলাকা থেকে মূর্তিটি আনা হয়েছে বলে পাচারকারীরা প্রাথমিক ভাবে জানিয়েছে, তাতে পুলিশ নিশ্চিত মূর্তিটি মহীপাল এলাকার। এই এলাকার গোবর্ধনডাঙা ও পাটকেলডাঙা অঞ্চলের গিয়াশাবাদ, হুকারহাট, সিংহেশ্বরী গৌরীপুর, ভুঁইহাট, মহীপাল, বিনোদ এলাকায় খনন করতে গিয়ে অতীতে অজস্র প্রত্ন সামগ্রী ও বেশ কয়েকটি কালো পাথরের মূর্তি উদ্ধার হয়েছে। গিয়াশাবাদের পূর্ব নাম ভাদুড়িহাট । প্রত্ন গবেষকরা জানান, মহীপালের গোটা গ্রাম জুড়েই বিভিন্ন সময়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রস্তর বিগ্রহ মিলেছে।
লোকশ্রুতি, এখানেই ছিল প্রথম মহিপালের রাজধানী। দশম-একাদশ শতকে গিয়াশাবাদ পাল রাজধানী মহীপাল নগরের অংশ ছিল বলে প্রসিদ্ধ। এখান থেকেই ক্যাপ্টেন লেয়ার্ড ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে পালিতে লেখা শিলালিপি, স্বর্ণ মুদ্রা ও বহু মৃতপাত্র পান। একটি মুণ্ডহীন দ্বাদশভুজ মূর্তিও এখান থেকেই উদ্ধার করে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সংগ্রহশালায় অর্পণ করেন। এখান থেকে পাওয়া বহু দেবদেবীর মূর্তি বিভিন্ন অন্য সংগ্রহশালাতেও রয়েছে। এলাকার বহু পরিবারের বাড়িতেই রয়েছে পাথরের এরকম বহু মূর্তি।
পুলিশের আশঙ্কা, এমন অনেক মূর্তি পাচারও হয়ে গিয়েছে। ২০১১ সালে এই গিয়াশাবাদ থেকে কালো পাথরের খোদাই করা গণেশ মূর্তি ও একাধিক ভাঙা পাথরের মূর্তি ও থালা উদ্ধার হয়। ভাগীরথী নদীর পাড় থেকে ২০০ মিটার দূরে একটি ইটভাটার মাটি খোঁড়ার সময় প্রায় সাড়ে ৫ ফুট লম্বা ও দেড় ফুট উচ্চতার কালো পাথরের চৌকাঠ খন্ড উদ্ধার হয়, যেটি এখনও সাগরদিঘি থানার চাতালে অযত্নে অবহেলায় পড়ে রয়েছে।
রাজ্যের এক পূর্বতন প্রত্ন অধিকর্তার মতে, পাল সেন রাজত্বের আধিপত্য ছিল গিয়াশাবাদে। সেখানেই এক মন্দিরে কালো পাথরের একাধিক মূর্তি রয়েছে, যা বিভিন্ন সময়ে মাটি খুঁড়ে উদ্ধার হয়েছে। প্রায় ৩৫ বছর আগে নিজের পুকুর সংস্কারের সময় দেড় ফুট উচ্চতার প্রায় ৭ কিলোগ্রাম ওজনের একটি কালো পাথরের বিষ্ণু মূর্তি পান গ্রামেরই লক্ষ্মণ প্রামাণিক। সেটি তাঁর বাড়ির মন্দিরেই স্থাপন করে পূজার্চনা করছেন। রঘুনাথগঞ্জ পুলিশের উদ্ধার হওয়া মূর্তিটিও একইরকম প্রায়। তবে এটি উচ্চতা ২ ফুট এবং ওজন প্রায় ১২ কিলোগ্রাম মতো।
মণিগ্রামেও এক বাড়িতে ঘর তৈরির সময় মাটির নীচে থেকে প্রায় ৪ ফুট উচ্চতার বিষ্ণুমূর্তি উদ্ধার হয়। পুলিশ সেখানে পৌঁছনোর আগেই গ্রামবাসীরা গ্রামের মন্দিরে মূর্তিটি বসিয়ে পুজার্চনা শুরু করে দেন। পরে মূর্তিটির ভাঙা অংশ সারিয়ে নেন গ্রামবাসীরা। পুলিশের সন্দেহ, ওই এলাকা থেকেই চোরাই মূর্তিটি আনা হয়েছে। এদের সঙ্গে প্রত্ন সামগ্রীর বিদেশি কারবারিদের কোনও যোগাযোগ আছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। কারণ বাইরের বাজারে চড়া দাম রয়েছে এই ধরনের ভারতীয় প্রত্ন সামগ্রীর।