আশায় বুক বেঁধেছে খোকন সিকদারের পরিবার ।
সাইকেলটা পড়েই ছিল। ‘ও’ চলে যাওযার পরে আর হাতই পড়েনি। ঝুল-জং’য়ে মাখামাখি সাইকেলটা নিয়ে রবিবার সাতসকালেই দোকানে য়াওয়ার তোড়জোড় করছিলেন তিনি—‘‘খুব খারাপ লাগছিল জানেন, মনে হচ্ছিল এখুনি বুঝি পিছন থেকে হাঁক পাড়বে, ‘আমার সাইকেলটা নিয়ে কোথায় চললে!’’
কেউ ‘হাঁক’ পাড়েনি। তবে একটা ডাক এসেছিল, ফোনে— ‘‘হ্যাঁ গো, দীপালি, শুনেছ খবরে নাকি বলেছে, সমর বেঁচে রয়েছে, ইরাকেই নাকি আছে!’’
আঁচলে চোখ মুছে সাইকেলটা নিয়ে তবু গিয়েছিলেন দীপালি। পা আর চলছিল না যেন। নগদ আটশো টাকা দিয়ে দিব্যি সারাইও করেছেন। বলছেন, ‘‘সারিয়ে তো রাখলাম, ও ফিরলে ওই চালাবে। আর আমার আইসিডিএস-র চাকরিটাও যদি হয়ে যায়....।’’
চিঠিটাও এসে পড়েছিল ক’দিন। আজ সেই আইসিডিএস’র কাজে যোগ দিতেই রওনা হচ্ছিলেন দীপালি। কিন্তু হারিয়ে যাওয়ায় যে মানুষটার জন্য তেতাল্লিশো টাকার এই চাকরি, সে ফিরে এলে? মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বলছেন, ‘‘এক কথায় ছেড়ে দেব, ঘরের মানুষ ঘরে ফেরার চাইতে আনন্দের কিছু আছে!’’
ওরা ফিরছে।
জেলাশাসকের কাছে দরবার সমর টিকাদারের স্ত্রী দীপালি।
কবে, কখন কেউ জানে না। তবে রবিবার রাতে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ আগাম ঘোষণা করে বসেছেন— ইরাকে অপহৃত ৩৯ জন ভারতীয় এখনও বেঁচে। যে তালিকায় রয়েছেন, চাপড়ার মহখোলার সমর টিকাদার এবং তেহট্টের ইলশামারির খোকন সিকদারও।
আর সেই খবরই কিনা সীমান্তের গ্রামে পৌঁছল সোমবার, সকালে। যে দিন পুরনো শাড়ি মাড় দিয়ে নতুন চেহারা ফিরিয়ে দীপালি চলেছেন আইসিডিএস’র চাকরিতে যোগ দিতে!
বছর দুয়েক আগে সুদূর ইরাকে ‘হারিয়ে’ গিয়েছিল মহিলার স্বামী সমর। সেই থেকে নেতা-মন্ত্রীদের কাছে কম দরবার করেননি দীপালি। বিজেপি-র রাহুল সিংহ থেকে মুখ্যমন্ত্রী, নিখোঁজ খোকন সিকদারের স্ত্রী নমিতাকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় ছোটেননি তিনি।
তবে ভপপরসা দিতে পারেননি কেউ-ই। কী করেই বা দেবেন, ধুধু বালির যুদ্ধ ধ্বস্ত পররাষ্টে তাঁদের দিন মজুর খাটতে যাওয়া হারানো স্বামীর খোঁজ পাওয়া কী অত সহজ।
ছেলে-মেয়ার মুখ চেয়ে তাই মন শক্ত করে ফেলেছিলেন দীপালি।
হাত দিয়েছিলেন বিড়ি বাঁধার কাজে। ‘‘প্রথমে খুব অসুবিধা হত। তামাক পাতার কী বাজে গন্ধ বাবা!’’ সময় সবই সহজ করে দেয়। এখন সেই তামাক পাতাই তাঁর ভরসা। বিড়ি বেঁধে দিনের েকসো দশ টাকার আয়েই সংসার টানা। আর মেয়ের পড়শোনা। দীপালি বলছেন, ‘‘হাঁফিয়ে উঠছি বুঝলেন এ বাবে সমসার চলে!’’
একটা চাকরির জন্য তাই কম ঘোরেননি তিনি। শেষতক, জেলা প্রসাসনই মুখ তুলে চেয়েছিল। চিঠি এসেছিল দশ কিলোমিটার দূরের কাঁদিপুরে আইসিডিএস থেকে।
কোনও ককিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেই চাকরিতেই যোগ দেওয়ার কথা ছিল সোমবার। আর কী আশ্চর্য, স্বামীর খবরটাও এল কিনা আজই!
বর্ডার রোড ধরে দশ কিলোমিটার ঠেঁকানো কাদিপুর। সাইকেল ছাড়া যাবে কী করে? তা, দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় টিভিতে খবরটা শুনে ফোন করেছিলেন এ দিনই সকালে—‘‘হ্যারে সমর তো বেঁচে আছে। রেডিওতে বলল।’’ এ দিন বড় রাগ হচ্ছিল, দীপালির। আলমারির মাথায় একটা টিভি তোলা আছে ঠিকই, কিন্তু সে তো মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে গত দু’বছকর ধরে। ‘‘কে সারাবে, টাকা কোথায়!’’ পুরনো একটা ট্রানজিস্টরও ছিল। কিন্তু ব্য়াটারির অভাবে সেটারও একই দশা। দীপালি তাই আত্মীয়দের বলে রেখেছেন— কেউ কিছু শুনলে জানিও।’’ চাকরি পেয়েছেন নমিতাও। আইসিডিএস। তবে সেখানে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে এখনও মনস্থির করতে পারেননি তিনি। এখনও যেন মনে হয়, স্বামী ফিরবে। বিড়বিড় করছেন, ‘‘তখন সংসারটা কে দেখবে!’’
তবে হারানো উদ্বেগটা পিরে ফিরেই আসছে। নমিতা বলছেন, ‘‘রোজা রাতে পরের দিন কী করে হাঁড়ি চড়াব সে তিন্তায় জেরবার হয়ে যাই।’’ ভিজে চোখে রোজই মনে হয় মানুষটা কোথায় আছে, বেঁচে তো! উঠোনে নেমে গড় করছেন নমিতা, ‘‘ভগবান বুঝি মুখ তুলে চাইলেন!’’
তাঁর বারো ক্লাসের মেয়ে, রিতার এখনও মনে আছে, রোজ রাতে তাঁর বাবার ফোন। বলছে, ‘‘মন বলছে এ বার আবার ফোন আসবে, বাবা বলবে, ‘চিন্তা করিস না এ বার ফিরব!’’
— নিজস্ব চিত্র