নবদ্বীপে গঙ্গায় এ ভাবে ফেলা হচ্ছে প্লাস্টিক। — নিজস্ব চিত্র।
গরম রসগোল্লার কড়াই তখন সবে উনুন থেকে নেমেছে। একেঁবেঁকে ওঠা ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে গোল গোল ছানার তাল। চেনা মিষ্টি দোকানে এমন অচেনা দৃশ্য দেখে নিজেকে সামলাতে পারেননি প্রদীপ চক্রবর্তী। সঙ্গে সঙ্গে গোটা দশেক রসগোল্লার অর্ডার দিয়ে টাকার জন্য পকেটে হাত ঢোকালেন। কিন্তু দোকানদারের কীর্তিকলাপ দেখে তাঁর চোখ ছানাবড়া।
কড়াই থেকে চিমটে দিয়ে এক এক করে রসগোল্লা তুলে সটান পলিব্যাগে চালান করছেন দোকানদার! প্রায় চেঁচিয়ে উঠে প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘ওটা কী করছেন ভাই?’’ প্রশ্ন শুনে দোকানদারও থ। পাল্টা প্রশ্ন জুড়লেন, ‘‘আপনি রসগোল্লা চাইলেন না ? তাই তো দিচ্ছি।” ‘‘ওই পাতলা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগেই দেবেন নাকি? কেন মাটির ভাঁড় নেই?” এ বার দোকানদার বুঝতে পারলেন গলদটা কোথায়। কিন্তু নির্বিকার ভাবে তিনি জানালেন, রসগোল্লা নিতে হলে ওই প্ল্যাস্টিকের ব্যাগেই নিতে হবে। মাটির ভাঁড়ের পাট কবেই চুকে গিয়েছে। এখন সবই বিকোচ্ছে ক্যারিব্যাগে। আর যাঁরা ক্যারিব্যাগ নিতে চান না তাঁরা বাড়ি থেকে টিফিন কৌটো আনেন। সে দিন আর গরম রসগোল্লা কেনা হয়নি নবদ্বীপে স্কুল জীবন কাটানো অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপ চক্রবর্তীর।
শহর নবদ্বীপে এ কোনও বিছিন্ন ঘটনা নয়। খাবারের দোকান থেকে মুদিখানা, সব্জিবাজার থেকে মাছ-মাংসের বাজার, সর্বত্রই এখন পলিব্যাগের রমরমা। গরমাগরম তেলেভাজা থেকে ত্বকচর্চার তেল সাবান শ্যাম্পু সবই বিকোচ্ছে সস্তার পলিপ্যাকে।
শহর জুড়ে পলিব্যাগের এই বল্গাহীন ব্যবহার নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রসঙ্গে নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাস। তিনি বলেন, ‘‘প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগের লাগামছাড়া ব্যবহারে নিকাশি ব্যবস্থা কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। পরিবেশ দূষিত তো হচ্ছেই, তার সঙ্গে দারুন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের স্বাস্থ্যও। প্রশাসনের উচিৎ কড়া পদক্ষেপ করে পলিব্যাগ যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করা।’’
একটা সময় ছিল, সব বাড়িতেই নানা রকমের থলে থাকত। সাদা ক্যাম্বিস, চট বিকল্পে বাড়ির পুরোনো কাপড়ের সেই সব থলের কোনটি কাঁচা আনাজের জন্য, কোনওটি মাছ, মাংসের জন্য। চাল বা মুদিবাজারের থলে ছিল তুলনায় একটু বড় আর মজবুত। ছবিটা বদলাতে শুরু করে আটের দশক থেকে। বাজারে এল নাইলনের ব্যাগ। শক্তপোক্ত নাইলনের ব্যাগ বহুদিন ব্যবহার করা যেত, তাকে ধুয়ে সাফ করাও যেত। কিন্তু ছবিটা আমূল বদলে গেল পলিব্যাগের সঙ্গে সঙ্গে।
এখন সাতসকালে বাজার করতে বেরিয়ে নানা রঙের, নানা আকারের গাদা খানেক পলিব্যাগে শাক-সব্জি-মাছ-মাংস কিনে বাড়ি ফেরাটাই শহরের চালু রেওয়াজ। সাইকেল বা মোটরবাইকের হ্যান্ডেলে ঝোলা পাতলা ক্যারিব্যাগ থেকে যদি কলাটা, মুলোটা নাই দেখা গেল, সদ্য কাটা মুরগির তাজা রক্ত যদি পলিব্যাগ ফুটে নাই দেখা গেল তবে বাজার করার মজাটা কোথায়। থলে হাতে বাজারে যাওয়া! সে তো কবেকার কথা। “আরে দাদা, এখন থলে-ফলে চলে নাকি। কখন কোথায় থাকি ঠিক নেই। তার জন্য বাড়ি থেকে থলে নিয়ে বেরতো। তার চেয়ে ক্যারিব্যাগই সই। যখন যেমন দরকার পড়ে, জিনিস কিনে বাড়ি ফিরি।’’—সাফ জানালেন এক গৃহকর্তা।
যদিও পলিব্যাগের অবাধ ব্যবহার নিয়ে ক্ষুব্ধ শহরের অনেকেই। কেন্দ্র সরকারের অর্থ মন্ত্রকের উৎপাদন এবং সীমা শুল্ক আধিকারিক সব্যসাচীবাবু বলেন, “যেভাবে নির্দিষ্ট গুণমানের বাইরে যথেচ্ছ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হচ্ছে তা মৃত্যুকে যেচে ডেকে আনার সামিল। এখনই কড়া পদক্ষেপ না নিলে ঘোর বিপদে পড়বে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।’’
এ প্রসঙ্গে বারাসাত রাষ্ট্রীয় মহাবিদ্যালয়ের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান তথা জীববিজ্ঞানী দেবজ্যোতি চক্রবর্তী জানান, প্লাস্টিকের প্রধান বিপদ এটি কোনও অবস্থাতেই পচনশীল নয়। যাকে পরিভাষায় ‘নন-বায়োডিগ্রেডেবল’ বলা হয়। বছরের পর বছর মাটির তলায় থাকলেও মিশে যায় না। উল্টে ভূগর্ভস্থ জল পৌঁছনোর পথে অন্তরায় হয়ে ওঠে। ন্যূনতম পক্ষে ৪০ মাইক্রোনের পলিব্যাগ ব্যবহারের কথা বলা হলেও সেই নিয়ম মানেন না কেউই। রঙিন পলিব্যাগে ‘ডাইইথিলিন’ বলে এক ধরনের রাসায়নিক থাকে যা ওই পলিব্যাগে থাকা মাছ, মাংস, মিষ্টি, তেলেভাজার মতো খাদ্যের সঙ্গে মিশে মানুষের দেহে ক্যানসার সৃষ্টি করে। আগুনে পুড়িয়ে পলিব্যাগ নিকেশ করা আরও বিপজ্জনক। পোড়া পলিব্যাগের ধোঁয়ায় ফুসফুসের ক্যানসারের সম্ভবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়। তিনি জানান, পলিব্যাগের ব্যবহার যারা আমাদের শেখাল সেই ইওরোপে এখন পলিব্যাগ নিষিদ্ধ। ওদেশে একটা আন্দোলন চালু হয়েছে যার নাম বিওয়াইবি বা নিজের ব্যাগ নিজে আনুন। না হলে আপনাকে দোকানদার জিনিসই বিক্রি করবে না। বয়কট করা হবে।
আমাদের দেশে এমন কোনও আন্দোলনের সম্ভাবনা দূর অস্ত। উল্টে পলিব্যাগ না দিলে অসন্তুষ্ট হন খরিদ্দার। এ ব্যাপারে বাজারের সব্জি বিক্রেতা থেকে নামীদামী দোকানের বিক্রেতা সকলের অভিজ্ঞতা কমবেশি এক। তাঁদের সাফ কথা ক্রেতা যদি সচেতন না হন তবে তাঁরা কেন ক্রেতাদের বিরাগভাজন হতে যাবেন। তবে শহরের কিছু কিছু দোকানদার নিজেদের উদ্যোগেই পলিব্যাগ বন্ধ করে দিয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, এ জন্য তাঁদের বিক্রি বিন্দুমাত্র কমেনি।
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব জানান, “নবদ্বীপ শহর কড়াইয়ের মতো। এ শহরে এমন অনেক জায়গা আছে যা গঙ্গার থেকেও নিচু। ফলে বর্ষাতেও বন্যার অভিজ্ঞতা আছে নবদ্বীপবাসীর। সে ক্ষেত্রে নিকাশি নালাগুলি সাফ রাখা জরুরি। কিন্তু শহরের প্রতিটি নিকাশি নালাই তো এখন পলিব্যাগে ভরে থাকে সব সময়। তা হলে বর্ষার অতিরিক্ত জল বের হবে কী ভাবে। তাঁর আবেদন, পলিব্যাগের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে দ্রুত উদ্যোগী হোক প্রশাসন।
তাঁর কথায়, ‘‘২০০৬ এর পর নবদ্বীপে তেমন কোনও বন্যা হয়নি। কিন্তু এই সময়ে পলিব্যাগের ব্যবহার বেড়েছে দশ গুণ। যদি ফের কখনও বন্যা হয় তাহলে পরিস্থিতি যে কি দাঁড়াবে তা কিন্তু কেউ জানি না।”
রাজ্যের বহু পুরসভা পলিব্যাগের ব্যবহার নিয়ে ইতিমধ্যে নানা নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও পর্যটকের শহর নবদ্বীপের পুরসভা এখনও তেমন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। পলিব্যাগের লাগামছাড়া ব্যবহার নিয়ে নবদ্বীপ পুরসভা কী ভাবছে তার উত্তরে উপ-পুরপ্রধান তথা শহরের জঞ্জাল বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত শচীন্দ্র বসাক নিজেও তার উদ্বেগ চেপে রাখতে পারেননি। তিনি বলেন, “যে ভাবে পলিব্যাগের ব্যবহার বাড়ছে তা সত্যিই উদ্বেগজনক।” তিনি আরও বলেন, “এখনও পর্যন্ত পুরসভার তরফে পলিব্যাগের ব্যবহার বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে শীঘ্রই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
এখন দেখার সেই ব্যবস্থা কত দিনে কার্যকরী হয়।
ধৃত বাবা। শান্তিপুরে নিহত কিশোরের বাবাকে গ্রেফতার করল পুলিশ। শনিবার বিকেলে ধৃত হাসান আলি মণ্ডল বাড়ি ফিরলে এলাকার বাসিন্দারা তাকে বেধড়ক মারধর করেন। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে শান্তিপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। বর্তমানে সেখানেই চিকিৎসাধীন। মঙ্গলবার থেকে নিখোঁজ ছিল শন্তিপুর সূত্রাগড় মানিকপাড়ার বাসিন্দা অষ্টম শ্রেণির ছাত্র হাসিব আলি মণ্ডল। ওই দিন বিকেলে বাগআছড়া কুঠিরপাড়ায় তার দেহ মেলে। তাকে খুন করা হয়েছে বলে পরিবারের লোকজনের দাবি। সেই খুনে নাম জড়ায় হাসানের।