চরের পরব

কাঁটাতারের এ পারে থমকে যান মা দুগ্গাও

পিঠোপিঠি দু’টো পরব। পাশাপাশি দু’টো দেশ। মাঝে পড়ে থাকে চর। অবহেলায়, অবজ্ঞায়। যন্ত্রণার সেই বারোমাস্যায় দখিনা বাতাসের মতো হাজির হয় ইদ কিংবা দুগ্গা পুজোও। গা থেকে বর্ষার শ্যাওলা ঝেড়ে জেগে ওঠে সীমান্তের সেই জনপদগুলো। পরবের সেই প্রস্তুতি ঘুরে দেখল আনন্দবাজারপিঠোপিঠি দু’টো পরব। পাশাপাশি দু’টো দেশ। মাঝে পড়ে থাকে চর। অবহেলায়, অবজ্ঞায়। যন্ত্রণার সেই বারোমাস্যায় দখিনা বাতাসের মতো হাজির হয় ইদ কিংবা দুগ্গা পুজোও। গা থেকে বর্ষার শ্যাওলা ঝেড়ে জেগে ওঠে সীমান্তের সেই জনপদগুলো। পরবের সেই প্রস্তুতি ঘুরে দেখল আনন্দবাজার

Advertisement

গৌরব বিশ্বাস ও সুজাউদ্দিন

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:২৭
Share:

গেট পেরোলেই চরমেঘনা। — ফাইল চিত্র।

‘‘মা, দুগ্গা ঠাকুরের কি ভোটার কার্ড নেই?’’

Advertisement

বছর দশেকের ছেলের প্রশ্নে চমকে ওঠেন চরমেঘনার ববিতা মণ্ডল।

তড়িঘড়ি ছেলের মুখে হাত দিয়ে বলে ওঠেন, ‘‘অমন কথা বলতে নেই বাবা। পাপ হবে। ঠাকুর-দেবতা সম্পর্কে এমনটা কেউ বলে?’’

Advertisement

শুভেন্দুও নাছোড়বান্দা, ‘‘হোক পাপ। আমাদের গ্রামে মা দুগ্গা আসে না কেন? চাই না আমার নতুন জামা!’’

কিছুতেই যেন খুদের রাগ কমছে না। একবার সে ধানের গোলার গায়ে জোরে ঘুঁষি মারল। গোলার কিছুই হল না। উল্টে নিজের হাতে আঘাত লাগাতে রাগ যেন আরও বেড়ে গেল।

উঠোন নিকোচ্ছিলেন ববিতা। এ বার রাগ গিয়ে পড়ল বালতির উপরে। নিকোনো উঠোনে গোবর জলের বালতি উল্টে শুভেন্দু ছুটল মাথাভাঙার পারে।

তিরতিরে নদীর এ পারে চরমেঘনা। ও পারে কুষ্টিয়ার জামালপুর, মহিষকুণ্ডি। দু’ পাড়ে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। শুভেন্দু গিয়ে বসল বাঁশবনের ছায়ায়। আদুল গা। হাতে গুলতি। সাঁ সাঁ শব্দে একটি করে গুলি ছিটকে গিয়ে ঝপাং করে মাঝ নদীতে। পাশে টহল দিচ্ছে বিএসএফ জওয়ান।

শরতের দুপুরে স্নানের ঘাটে ভালই ভিড়। ও পারে বাবলা গাছের নীচে বসে ঝিমোচ্ছিলেন জামালপুরের এক প্রৌঢ়। চেনা মুখ দেখে প্রশ্নটা উড়ে গেল, ‘‘ও মিঞা, ইদের বাজার হল?’’

‘‘জি, কর্তা। কিনাকাটা শ্যাষ। তা, আপনাগো পুজোও তো আগায়ে এল।’’ শরতের দুপুরে ফের মনখারাপ করিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গ।

স্নান শেষে ভিজে পোশাকে গ্রামের দিকে আসতে আসতে বিড়বিড় করছেন চরমেঘনার উত্তম মণ্ডল, ‘‘আমাদের আবার পুজো! নতুন পোশাক আছে। নাড়ু-মুড়কি আছে। উপোস আছে। সম্বৎসর অপেক্ষা আছে। কিন্তু পুজোটাই নেই।’’

ভৌগোলিক ভাবে চরমেঘনা আর পাঁচটা গ্রামের মতো নয়। হোগলবেড়িয়ার মেঘনা বিএসএফ ক্যাম্প থেকে প্রায় একশো মিটার দূরে ইন্দো-বাংলাদেশ বর্ডার রোড। কাঁটাতারের বেড়া। রাস্তার এ পাশে বিএসএফের নজরদারি চৌকি।

সেখানে ভোটার কার্ড দেখিয়ে, প্রশ্নবাণ সামলে বিএসএফের অনুমতি মিললে তবেই ছাড়পত্র মেলে চরমেঘনা যাওয়ার। কাঁটাতারের গায়ের লোহার গেট পেরিয়ে থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে এগিয়ে গেলে চরমেঘনা। গ্রামের পিছনে মাথাভাঙা।

গ্রাম থেকে বেরনোর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। সবথেকে বড় কথা, সন্ধ্যার পরে বন্ধ হয়ে যায় কাঁটাতারের গায়ের ওই লোহার গেট। দেশে থেকেও যেন দেশের বাইরে। দুই স্বাধীন দেশের মাঝে অসহায় ভাবে জেগে থাকে চরমেঘনা।

সেই গ্রামে পুজো?

নাহ্, এতবড় সাহস এখনও চরমেঘনা দেখায়নি। বলা ভাল, সামর্থ্যেও কুলোয়নি। চরে ১৭০ ঘর লোকের বাস। বেশির ভাগ বাড়িতেই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। যে দু’এজন চাকরি পেয়েছেন তাঁরাও গ্রামের বাইরে। ফি বছর পুজোর ছুটিতে বাড়ি আসতে পারেন না।

তাঁদেরই একজন অনিমেষ মাহাতো। সেনাবিভাগে চাকরি করেন। এখন রাজস্থানে। ফোনে অনিমেষ বলছেন, ‘‘জানেন, নদীর ধারে কাশফুল ফুটলেই মনখারাপ হয়ে যেত। সেই ছোট থেকেই দেখে আসছি, সবার গ্রামে পুজো আছে। আমাদের গ্রামে নেই। বেশ কয়েক বার জেদ করেছিলাম, পুজোর আয়োজন করবই। কিন্তু বিশ্বাস করুন, পেরে উঠিনি।’’

চরমেঘনা থেকে হোগলবেড়িয়ার দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। সেখানে জাঁকজমক করে হয় নস্করী মায়ের পুজো। বহু প্রাচীন। চরমেঘনা অষ্টমীর অঞ্জলি দেয় সেখানেই। তবে সকলেই যেতে পারেন না। বছর কয়েক আগে বিএসএফের উদ্যোগে গাড়িতে করে রাতে ঠাকুর দেখতে পেয়েছিল চরমেঘনা। এ বারেও যে তেমন কিছু হবে, তার নিশ্চয়তা নেই।

অনিশ্চয়তায় ভুগছে জলঙ্গির চর উদয়নগর খণ্ডও। সেখানে অবশ্য কাঁটাতারের বেড়া নেই। কিন্তু বিএসএফ আছে। সীমানা নিয়ন্ত্রণ করে পদ্মা। এ গ্রামেও পা পড়েনি মা দুগ্গার। শরতের রোদে চিকচিক করছে ভরা পদ্মা। মাথা দোলাচ্ছে কাশের দল। পদ্মার ওপারে বাংলাদেশ।

আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে ফরিদপুর থেকে এই চরে এসে সংসার পেতেছেন সুরবালা বিশ্বাস। বছর পঁচাত্তরের ওই বৃদ্ধার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, ‘‘কী ধুমধাম করে পুজো হত বাড়িতে। সব দায়িত্ব আমাকেই সামলাতে হত।’’ আর এখন? দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন সুরবালা, ‘‘আকাশে নীলকন্ঠ, নদীর ধারে কাশ, শিউলির সুবাস আর শরতের সোনা রোদ মনে করিয়ে দেয় পুজো এসে গিয়েছে। কত দিন যে মায়ের মুখ দেখতে পায়নি!’’

পরবের সময় উদয়নগরের মনখারাপের খবর রাখে মুসলিমপাড়া কিংবা পাশের চর পরাশপুর। ইদের দু’দিন আগেই চলে আসে দাওয়াত, ‘‘দুপুরের নেমতন্ন থাকল। সপরিবারে আসা চাই কত্তা।’’

সন্ধ্যার পরে বন্ধ হয়ে যায় চরমেঘনার লোহার গেট। কুপি জ্বলে ওঠে উদয়নগর, পরাশপুরে। দূর থেকে ভেসে আসে ঢাকের বাদ্যি। বছর দশেকের দামালকে ঘুম পাড়ান ববিতা, ‘‘দেখবি একদিন আমাদের গাঁয়েও মা দুগ্গা আসবে। বিরাট মণ্ডপ হবে। কত আলো জ্বলবে....।’’

বাইরে দূরে একটানা ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডেকে চলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন