বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটি

দশ বিদেশি ছবি চলচ্চিত্র উৎসবে

রাজ্যে ফিল্ম সোসাইটি খুব কম নেই। কিন্তু ক’টা সোসাইটির আছে নিজস্ব প্রেক্ষাগৃহ? বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটি-র সম্পাদক সমীরণ বিশ্বাস বুক ঠুকে বললেন, ‘‘বেঙ্গালুরুর সুচিত্রা ফিল্ম সোসাইটি ছাড়া ভূ-ভারতে আর কোনও ফিল্ম সোসাইটির ঋত্বিক সদনের মতো প্রেক্ষাগৃহ নেই।’’

Advertisement

অনল আবেদিন

বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:৫০
Share:

রাজ্যে ফিল্ম সোসাইটি খুব কম নেই। কিন্তু ক’টা সোসাইটির আছে নিজস্ব প্রেক্ষাগৃহ?

Advertisement

বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটি-র সম্পাদক সমীরণ বিশ্বাস বুক ঠুকে বললেন, ‘‘বেঙ্গালুরুর সুচিত্রা ফিল্ম সোসাইটি ছাড়া ভূ-ভারতে আর কোনও ফিল্ম সোসাইটির ঋত্বিক সদনের মতো প্রেক্ষাগৃহ নেই।’’ তাঁর গর্বের ৩৬০ আসনের সেই প্রেক্ষাগৃহে এখন চলছে ‘ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটজ অব ইন্ডিয়া’ (এফ এফ এস আই)-এর পূর্বাঞ্চল শাখার প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। দেখানো হচ্ছে ১১টি ছবি। তার মধ্যে ১০টিই বিদেশি।

উৎসবের ইতিহাস অবশ্য ঋত্বিক সদনের চাইতে ঢের প্রাচীন। ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রয়ারি, ভাষাশহিদ দিবসের সকাল। ঘড়ির কাঁটা তখন ৯টা ছুই ছুই। বহরমপুরের অভিজাত প্রেক্ষাগৃহ মোহন সিনেমা হল শহরের সংস্কৃতিমনস্ক মানুষে পূর্ণ। টান টান উত্তেজনা। এখুনি শুরু হবে ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’। তার পরেই ‘রোমিও জুলিয়েট অ্যান্ড ডার্কনেস’। আর সেই মুহূর্তে থেকে শুরু হবে তৎকালীন মফসসল বাংলার সিনেমা আন্দোলনের একমাত্র সংগঠন ‘বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটি’র পথচলা। হলও তাই।

Advertisement

ফের ওই দিনই সন্ধ্যায় ছিল ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘পোর্ট্রেট অব এ সিটি’ এবং ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’। কিন্তু সন্ধ্যায় তো মোহন সিনেমা হলের নিজস্ব সিনেমা রয়েছে। অগত্যা কৃষ্ণনাথ কলেজের পিটি হলকেই অস্থায়ী সিনেমা হল বানিয়ে দেখানো হল ওই তিনটি সিনেমা।

শুরুতে এ রকম যাযাবরের জীবন হলেও, আজ আর সে দিন নেই। আয়োজক সংস্থার সহ-সম্পাদক সমীর সরকার জানালেন, বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটির রয়েছে সিনেমা সংক্রান্ত দেশি-বিদেশি ৪৫০টি পুস্তকে সমৃদ্ধ নিজস্ব গ্রন্থাগার। নিয়মিত প্রকাশিত হয় ইংরাজি ও বাংলা ভাষায় ২টি পত্রিকা। রয়েছে নিজস্ব প্রকাশনাও। প্রকাশিত হয়েছে প্রখ্যাত ধীমান দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘সিনেমার প্রেক্ষাপট’ নামের মূল্যবান গ্রন্থ।

বস্তুত বহরমপুর শহরের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে এই ফিল্ম সোসাইটি। বহরমপুর পুরসভা থেকে ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘ইতিহাসের আলোকে বহরমপুর পৌরসভা’ নামের একটি আকর গ্রন্থ। সেই গ্রন্থের একটি প্রবন্ধের লেখক কৃষ্ণনাথ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক তথা ‘বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটির সহ-সভাপতি সুশান্তকুমার চট্টোপাধ্যায়। সুশান্তবাবু লিখেছেন, ‘‘১৯৬৪ সালে বহরমপুর শহরে ‘পুনশ্চ’ নামে একটি সংস্থা সৃষ্টি হয়। এদের উদ্দেশ্য ছিল সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিল্পের আধুনিক ধারাকে জনসমক্ষে তুলে ধরা। অচিরেই সেই সংস্থাটি বহরমপুরের সংস্কৃতি জগতে একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে। পরবর্তীকালে সেই ‘পুনশ্চ’ই বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটিতে রূপান্তরিত হয়।’’ তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটির প্রথম কার্যকরী সমিতির সভাপতি ছিলেন কৃষ্ণনাথ কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ডঃ রামচন্দ্র পাল এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ওই কলেজেরই তরুণ অধ্যাপক দীপঙ্কর চক্রবর্তী।

বহরমপুর ঋত্বিক ঘটকের বেড়ে ওঠারও শহর। ফলে এই সোসাইটি তাঁর ‘অযান্ত্রিক’ ছবিটি দিয়ে পথ চলা শুরু করে। সোসাইটির নিজস্ব আধুনিক প্রেক্ষগৃহেরও নাম রাখা হয় ‘ঋত্বিক সদন’। বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে বা আলোচনাসভায় ঋত্বিক সদনে পা রেখেছেন মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, এন বিশ্বনাথন, অশোক বিশ্বনাথন, অনিল চট্টোপাধ্যায়, অনুপ কুমার, রাজা সেন, বাংলাদেশের সাজাহান চৌধুরী। ওই তালিকা আরও দীর্ঘ।

এ বার বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটির ৫১তম বছরে ঋত্বিক সদনে গত শুক্রবার শুরু হওয়া ‘ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটজ অব ইন্ডিয়া’- এর প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট সিনেমা পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার অতনু ঘোষ।

দীর্ঘ কয়েক বছর বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটির সম্পাদকের দায়িত্ব সামলেছেন গৌতমবিকাশ চক্রবর্তী। ঋত্বিক সদন নির্মাণে তাঁর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ২০০৬ সালে তিনি অল্প বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর স্মৃতিতে প্রতি বছর চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আয়োজন করা হয় ‘গৌতমবিকাশ চক্রবর্তী স্মারক বক্তৃতা।’ এ বারের সেই বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘বাংলা চলচ্চিত্রের অভিনয় পরম্পরা’। সেই বিষয়ে আলোচনা করেন সিনেমা পরিচালক অতনু ঘোষ। সিনেমা শিল্পের উদ্ভব থেকে শুরু করে ক্রমবিকাশের নানা বাঁক আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বিশ্ব-সিনেমা থেকে শুরু করে বাংলা সিনেমার আধুনিক কাল অর্থাৎ ‘পথের পাঁচালি’ পর্যন্ত দর্শকদের দেখিয়েছেন, শুনিয়েছেন।

বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটির অন্যতম কর্মকর্তা অরূপ সেন বলেন, ‘‘ওই সোসাইটি শুধু বড়দের কথা ভেবে বড়দের জন্যই চলচ্চিত্র উৎসব করে না। করে নিয়মিত শিশু চলচ্চিত্র উৎসবও।’’ বহরমপুর কলেজে আর পাঁচটা বিষয়ের মতো রয়েছে ‘ফিল্ম স্টাডিজ।’ অরূপবাবু বলেন, ‘‘বহরমপুর কলেজের ওই বিষয়ের পড়ুয়াদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটির গ্রন্থাগারের দরজা।’’ সুশান্তকুমার চট্টোপাধ্যায় জানান, নিয়মিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ছাড়াও আয়োজন করা হয় সিনেমা সংক্রান্ত কর্মশালা ও বিতর্কসভা। এ ভাবেই এগিয়ে চলেছে ৫১ বছর ধরে ফিল্ম সোসাইটি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন