আগের মতো খেলোয়াড় কই, আক্ষেপ

শহরের ট্রাঙ্গুলার মাঠে বসেছে ফুটবলের আসর। চারদিকে থিকথিক করছে ভিড়। এক দিকে ইংল্যান্ডের লিংকন দল। অন্য দিকে, ঘরের ছেলেদের টিম কা়ঞ্চনতলা ধুলিয়ান অ্যাথলেটিক ক্লাব। টক্কর চলছে সমানে সমানে।

Advertisement

বিমান হাজরা

ধুলিয়ান শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৫ ০০:৪৯
Share:

এ ভাবেই সারা বছর ডুবে থাকে কাঞ্চনতলা স্কুল মাঠ। — নিজস্ব চিত্র ।

শহরের ট্রাঙ্গুলার মাঠে বসেছে ফুটবলের আসর। চারদিকে থিকথিক করছে ভিড়। এক দিকে ইংল্যান্ডের লিংকন দল। অন্য দিকে, ঘরের ছেলেদের টিম কা়ঞ্চনতলা ধুলিয়ান অ্যাথলেটিক ক্লাব। টক্কর চলছে সমানে সমানে। যদিও শেয পর্যন্ত দু’গোলে হার মানতে হয় ‘কেডিএসি’কে। কিন্তু পরাজয়ের গ্লানি কোথাও ছাপ ফেলেনি দর্শকদের মনে। লড়াই করে হেরেছে এই অনুভূতি নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলেন ধুলিয়ানের মানুষ।

Advertisement

বাপ-দাদাদের কাছে শোনা গল্প এ ভাবেই শোনাছিলেন এক সময়ে মুর্শিদাবাদ জেলা ভলিবল দলের ক্যাপ্টেন সজলেন্দু সরকার। কথা বলতে বলতে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল তাঁর। কিন্তু এক সময় কথার চেয়ে আক্ষেপটাই বড় হয়ে ওঠে। তাঁর কথায়, ‘‘বড় দুঃখ হয় এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের দেখে। খেলার প্রতি আগ্রহ নেই কারও। অবসর সময়ে তারা হয় ক্যারম পেটে নয় তো তাস। এক সময়ে খেলাধুলোর পীঠস্থান ধুলিয়ানে এখন খেলার জন্য লোক মেলে না।’’

এক সময় এই শহরে মাঠ কাঁপিয়ে বেড়াতেন পুরপ্রধান সুধীর সাহা ও সত্যদেব গুপ্ত। ফুটবলে সুধীরবাবু জায়গা করে নিয়েছিলেন কলকাতার জর্জ টেলিগ্রাফেও। আর সাইক্লিস্ট হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন সত্যদেব গুপ্ত। অলিম্পিক ফুটবলে জায়গা করে নিয়েছিলেন ধুলিয়ানেরই ছেলে সূর্য চক্রবর্তী। ভলিবলে জেলা দলের ক্যাপ্টেন হয়েছিলেন সজলেন্দু সরকার। খেলোয়াড় হিসেবে এক সময় লোকের মুখে মুখে ফিরত অমল সরকার, সমরেন্দ্রনাথ রায়, ব্যাডমিন্টনে শিশিররঞ্জন দাসদের নাম। ধুলিয়ান কাঞ্চনতলার নাম শুনলে ভিড় উপচে পড়ত ফুটবল মাঠে। কিন্তু আজ সেই শহরেই খেলার পাটটাই লুপ্ত হওয়ার পথে। লক্ষ লোকের শহর ধুলিয়ানে এমন একজন তরুণকে খুঁজে পাওয়া ভার যে কোথাও কোনও খেলার সঙ্গে জড়িত।

Advertisement

পরবর্তী প্রজন্মে ফুটবলকে কিছুটা হলেও শক্ত হাতে যাঁরা আঁকড়ে ধরেছিলেন তাঁদের একজন হলেন বিপ্লব সাহা। স্কুলের হয়ে খেলতে যেতেন বিপ্লববাবু। তার আমলেই শহরের ইলেভেন স্টার অ্যাথলেটিক ক্লাব এলাকায় নামী ফুটবলদলগুলির তালিকায় নিজেদের নাম উঁচু করে ধরেছিল। আজ সেই ক্লাবে খেলার বালাই নেই। কারণ, মাঠের অভাব যেমন রয়েছে তেমনই খেলোয়াড়ের সঙ্কটও। বিপ্লববাবুর কথায়, ‘‘ফুটবল বা ভলিবল, সব আউটডোর গেমেই দরকার কায়িক পরিশ্রমের। বর্তমান তরুণদের মধ্যে ঘাম ঝরিয়ে পরিশ্রমের আগ্রহ, উত্সাহ কোনওটাই নেই।’’ তিনি বলেন, ‘‘শহরে মাঠের অভাব রয়েছে সত্যি। কিন্তু তরুণদের মধ্যে খেলায় আগ্রহ কই। জোর তো আগ্রহ সৃষ্টি করা যায় না। তা তৈরি হয় স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে।ধুলিয়ানে সেই উত্সাহের অভাব।’’

তাই শহরের একমাত্র খেলার মাঠ গরুরহাট লাগোয়া কাঞ্চনতলা স্কুলের মাঠটি জবরদখলকারীদের কব্জায় চলে গেলেও তার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ নেই। মাঠের যেটুকু অংশ পড়ে রয়েছে সেটাও জল জমে ডোবার আকার নিয়েছে। প্রায় ৮ বিঘে মাঠের ইতিমধ্যেই ২ বিঘে জমি জবরদখল হয়ে গিয়েছে। বাকি মাঠের আকার অনেকটা হাতের তালুর মতো। ফলে বছরে প্রায় ১০ মাসই জল জমে থাকে। মাঠ লাগোয়া জমিতেই গড়ে উঠেছে সবুজ সঙ্ঘ। সঙ্ঘের সভাপতি আসকারুল ইসলাম বলেন, ‘‘মাঠের এই দুরবস্থা সরজমিনে দেখে গিয়েছেন বিভিন্ন দলের মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদেরা। প্রকাশ্য জনসভা করে মাঠ সংস্কারের কথাও শুনিয়েছেন। কিন্তু মাঠের দুরবস্থা আজও ঘোচেনি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘পুরসভাও দায়িত্বহীন। শহরে অনেক ব্যবসায়ী আছেন যাঁরা অনায়াসেই মাঠটি সংস্কার করে দিতে পারেন। তাঁরাও কেউ গা করেননি। উদ্যোগের অভাব রয়েছে কাঞ্চনতলা স্কুল কর্তৃপক্ষেরও।’’

যদিও অভিযোগ মানতে চাননি স্কুল কর্তৃপক্ষ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফাইজুদ্দিন বিশ্বাস বলেন, ‘‘স্কুলের কোনও অনুমতি ছাড়াই ধুলিয়ান পুরসভা খেলার মাঠের জমি দখল করে সেখানে জলাধার তৈরি করেছে। আমরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের চাপে শেষ পর্যন্ত তা পারিনি।’’ তিনি জানান, তখন পুরসভার কর্তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন মাঠের বাকি অংশটি সংস্কার করে চারিদিক লোহার পাইপ দিয়ে ঘিরে দেবেন। কিন্তু কথা রাখেননি কেউই।

ধুলিয়ানের বর্তমান পুরপ্রধান সুবল সাহা বলেন, ‘‘ধুলিয়ানের মতো শহরে খেলার মাঠ না থাকার যন্ত্রণাটা আমারও কম নয়। খেলা না থাকলে শহরের স্বাস্থ্যও বাঁচবে না। তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করা যাবে না। তাই ওই মাঠ সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যেই একটি প্রকল্প তৈরি করে রাজ্য সরকারের কাছে জমা দিয়েছি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আশা করছি তিন মাসের মধ্যেই স্কুল মাঠ সংস্কারের কাজ শুরু করতে পারব। শুধু তাই নয়, পুরসভা থেকে একটি ব্যাডমিন্টনের ইনডোর স্টেডিয়াম চালুরও চেষ্টা চলছে।’’

তিনি জানান, শহরের তরুণদের খেলার ব্যাপারে উত্সাহী হতে হবে। পুরসভার মতো কোনও সংস্থা খেলার পরিকাঠামো তৈরি করে দিতে পারে মাত্র। খেলোয়াড় তৈরি করতে পারে না। তাঁর কথায়, ‘‘তাই খুব শীঘ্রই শহরের অতীত দিনের খেলোয়াড়দের নিয়ে আলোচনায় বসব। তাঁদের পরামর্শ নেব। ফুটবলে ধুলিয়ানের অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে রাজনীতি ভুলে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।’’

যা শুনে পুরসভার বিরোধী নেতা কংগ্রেসের সফর আলি বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে পুরসভা উদ্যোগী হলে আমরা পাশে থাকব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন