মায়াপুর ইস্কন থেকে রথ যাচ্ছে রাজাপুর জগন্নাথ মন্দিরে। ডান দিকে, ডোমকলে নমাজে মগ্ন দুই খুদে। সুদীপ ভট্টাচার্য ও সাফিউল্লা ইসলামের তোলা ছবি।
একটা মামুলি পাঁচিল। একটু লম্বাটে। পাঁচিলের এক পাশে জগন্নাথ মন্দিরের প্রশস্ত নাটমন্দির। অন্য পাশে জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছড়ানো উঠোন বর্ষায় সবুজ।
ওই উঠোনেই পশ্চিমমুখো হয়ে এক মনে ‘আসরের’ নমাজ পড়ছিলেন প্রবীণ মানুষটি। খোলকর্তাল জগঝম্প বাজিয়ে সবে পাশ দিয়ে গিয়েছে ইস্কনের রথ। হাজার মানুষের পায়ে পায়ে রাজাপুরের সুরকির রাস্তার লালধুলো তখনও বাতাসে উড়ছে। শোভাযাত্রার পিছনে চলা ছন্নছাড়া ভিড়ের আওয়াজ ছাপিয়ে দূর থেকে ভেসে আসছে সংকীর্তনের সুর। রথযাত্রা এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে নমাজ। মোনাজাত সেরে পশ্চিমদিক থেকে চলে যাওয়া রথের দিকে ঘুরে মানুষটি চোখ বুজে বলেন ‘জগন্নাথস্বামী, নয়ন পথগামী...’ আষাঢ় বিকেলের ভিজে আলোয় নদিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামটি কেমন যেন অপার্থিব হয়ে ওঠে।
প্রতি বছর আষাঢ় শেষের বেলায় এমনই এক আশ্চর্য রথযাত্রার সাক্ষী থাকেন রাজাপুরে উপস্থিত দেশবিদেশের হাজার হাজার মানুষ। দেখেশুনে এ বার তাঁরা খানিকটা ধন্ধে পড়েছেন। তাহলে কোনটা সত্যি? এই রাজাপুর, নাকি নদিয়ার সীমানা পেরিয়ে ওই গুলশন? হাড়হিম করা গুলশনের কাণ্ডের পর তাঁদের বিস্ময় মোটেই অস্বাভবিক নয়। কিন্তু চৈতন্যভূমি নবদ্বীপ এ ভাবেই সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে আসছে সাড়ে পাঁচশো বছর ধরে।
রাজাপুরের জগন্নাথ মন্দির, যেখান থেকে ইস্কনের রথের যাত্রা শুরু সেখানে মন্দির মাদ্রাসা পিঠোপিঠি অবস্থান করে। আশপাশের সরডাঙ্গা, গোমাঘর, নতুনগ্রামের মতো মুসলমান প্রধান অঞ্চলের মানুষের কাছে ইদ,মহরমের মতো রথও একটা উৎসব। শুধুমাত্র রথের দড়ি টানবেন বলে ফকির শেখ, মুকশেদ আলি, সুন্দর শেখেরা ফি বছর রথের দিন চেষ্টা করেন কাজে না যেতে। নিতান্তই যেতে হলে? স্পষ্ট উত্তর “আধবেলা করেই চলে আসি।” এলাকার বেশির ভাগ মানুষ রাজমিস্ত্রি, দিনমজুরের কাজ করেন।
শুরু থেকেই ইস্কনের মায়াপুর বা রানাঘাট হবিবপুরের রথের যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণ সবই হয় সুন্দর শেখ, মহম্মদ সুকুর আলি বা আখতার আলির তত্ত্বাবধানে। রথে রং করতে করতেই ওরা সেরে নেন জোহরের নমাজ। ইস্কনের জনসংযোগ আধিকারিক রমেশ দাস বলেন, “এই রথযাত্রা সর্বধর্মের অংশগ্রহণে মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে। ওঁদের ছাড়া মায়াপুরের রথযাত্রা অসম্পূর্ণ মনে হয়।”
এবারে ইদ আর রথযাত্রা কাছাকাছি। তাই ইস্কনের তরফে এবার রথের উদ্বোধনে আনা হচ্ছে না ছোট বা বড়পর্দার কোনও চেনা মুখ। বুধবার দড়ি টেনে রথযাত্রার সূচনা করার কথা হাইকোর্টের বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডনের। অন্য দিকে রথের কথা মাথায় রেখে ইদ উপলক্ষে রাজাপুরের রাস্তায় গেট সাজানো হয়নি এ বার।
ছবিটা একই রকম পড়শি জেলা মুর্শিদাবাদেও। খুশির ইদের লাস্যময়ী লাচ্চার রসে আর রথযাত্রার স্লিম ফিগারের মুচমুচে পাঁপড়ের স্বাদে বুধবার থেকে সপ্তাহখানেক মম করবে তামাম মুর্শিদাবাদ। লাচ্চার সঙ্গে ভোনা সেমুই আর পাঁপড়ের সঙ্গে রসালোও জিলিপিও রাজ করবে সোজা রথ থেকে উল্টোরথ পর্যন্ত সাত দিন ধরে। পঞ্জিকার গুণে এবার রথযাত্রা ও ইদের খুশির লগ্নে একাকার হয়ে উৎসবের আনন্দ উপচে পড়ছে মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে।
সঙ্গে কান্দি, অরাঙ্গাবাদ, জিয়াগঞ্জ তো বটেই, আজ থেকে মাস ব্যপী ঐতিহ্যের রথের মেলার আয়োজনে ব্যস্ত বাংলাদেশের সীমানা লাগোয়া পদ্মাপাড়ের লালগোলাও। প্রয়াত দানবীর মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়ের প্রতিষ্ঠিত লালগোলার রাজবাড়ির রথ দুই বাংলার দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির রথ হিসাবে সেই আদ্দিকাল থেকে প্রসিদ্ধ। লালগোলা এম এন অ্যাকাডেমির শিক্ষক জাহাঙ্গির মিঞা বলেন, ‘‘এক সময়ে বাংলাদেশের উভয় সম্প্রাদায়ের মানুষ পদ্মা পার হয়ে এক মাস ধরে রাজবাড়ির আশ্রয়ে পণ্য ও পূণ্য দুটোই সংগ্রহ করে ওপারে ফিরে যেতেন।’’দেশভাগ হলেও ইদ ও রথের সময় সীমান্তরক্ষীদের রক্তচক্ষু একটু নরম হয়। রাজবাড়ির রথে দুই বাংলা এক হয়ে যায়। গুলশান কাণ্ডের ফলে এ বার তা ব্যতিক্রম।
লালগোলার মল্লিকপুরের সারজেমান শেখ বলেন, ‘‘ঢাকার গুলশানে জঘন্য জঙ্গিহানায় ২০ জন নিরপরাধের প্রাণ গিয়েছে। তারপর থেকে সীমান্ত দিয়ে মাছি গলার উপায় নেই।’’ সারজেমানের খেদ, ‘‘রথের মেলার সার্কাসের দিকে সারা বছর তাকিয়ে থাকতাম আমরা। এখন সে সবই বন্ধ!’’