সে-ও এমনই এক ভোটের সময়। সালটা ১৯২৩। দেশের আইনসভার নির্বাচন ঘিরে প্রবল উৎসাহ। ভোটে লড়ছে স্বরাজ্য দল। দিল্লিতে তখন স্বরাজ্য দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মতিলাল নেহরু। বাংলায় চিত্তরঞ্জন দাশ।
কলকাতা উত্তর-মধ্য নির্বাচনী ক্ষেত্রে স্বরাজ্য দলের প্রার্থী হলেন দেশবন্ধুর অনুগামী এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির কোষাধ্যক্ষ নির্মলচন্দ্র চন্দ, ঐতিহাসিক প্রতাপচন্দ্র চন্দের বাবা। সেই নির্বাচনে মুসলিমদের সঙ্গে পাওয়ার জন্য মতিলাল-দেশবন্ধু ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামে এক চুক্তি স্বাক্ষর করলেন। যা মোটেই ভাল চোখে দেখলেন না সে কালের গোঁড়া হিন্দুরা।
তাঁরা নির্মলচন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিনব প্রচারে নামলেন। লরির মিছিল। প্রতিটি লরির উপর একটি করে গরু। তাঁদের গলায় বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড ঝোলানো। কোনটায় লেখা ‘স্বরাজ্য দল মুসলিমদের সঙ্গে প্যাক্ট করেছে, গো-হত্যায় বাধা দেবে না’ কোনটায় লেখা ‘স্বরাজ্য দলকে ভোট না দিয়ে, আমায় রক্ষা করুন’ ইত্যাদি। এমন প্রচারে ত্রাহি মধুসুদন রব উঠে গেল স্বরাজ্য দলের অন্দরে। শেষপর্যন্ত তাঁরা গিয়ে পড়লেন দাদাঠাকুরের কাছে। প্রতাপচন্দ্র চন্দ এই প্রসঙ্গে তাঁর ‘স্মৃতিকথায়’ লিখছেন “সকলের বিশ্বাস দাদাঠাকুর ওই মিছিলের প্রতিবাদ করে একটা জম্পেশ প্যারোডি লিখে দিলে মিছিল করে তা প্রচার করা যাবে। জুতসই জবাব দেওয়া যাবে বিরোধীদের।”
আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
দাদাঠাকুর এর জবাবে কী গান বেঁধেছিলেন, তার হদিস দিতে পারেননি প্রতাপ চন্দ। কিন্তু সে কালের ভোট তাঁর লেখা ব্যঙ্গগীতিতে কী ভাবে ভরে উঠত তার একাধিক নমুনা তিনি পেশ করেছেন। এর মধ্যে কীর্তনের সুরে “আমি ভোটের লাগিয়া ভিখারি সাজিনু, ফিরিনু গো দ্বারে দ্বারে” বা ছেলে ভুলানো ছড়ার স্টাইলে ‘‘আয় ভোটার আয় ভোট দিয়ে যা’’ তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল।
নীরস ভোট প্রচারে ভোটারের মন মজাতে প্রচারে ছড়ার ব্যবহারের সেই শুরু বাংলাদেশে। পরবর্তী কালে যা অনিবার্য হয়ে ওঠে। নয়ের দশক থেকে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ালে লেখা ভোটের ছড়ায় ভাটার টান ধরলেও তার আবেদন এখনও একেবারে হারিয়ে যায়নি। বরং দেওয়াল পাল্টে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ওয়ালে’ ভোটচর্চা এখন ফের জনপ্রিয় হচ্ছে।
তাই এবারও ভোট আসতেই বিলকুল পাল্টে গিয়েছে লোনাধরা বালি ধসা, স্যাঁতা পড়া দেওয়ালগুলো। পাড়া-বেপাড়ার গুরুত্বপূর্ণ মোড় কিংবা ব্যস্ত পথের ধারের ঝাঁ-চকচকে কুলিন প্রাচীরও ভোটের ছন্দে-বর্ণে রঙিন। বছরভর যে সব দেওয়াল নামিদামী ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনে পথচলতি মানুষের নজর কাড়ে। সেখানে এখন ছড়ার ছড়াছড়ি। রংবাহারি সেই সব প্রাচীর গাত্র ছড়ায়-ছবিতে ভোট প্রচারের সহজপাঠ হয়ে উঠছে।
ভোটের দেওয়ালে বেশি করে চোখে পড়ছে বামেদের কটাক্ষ ‘পুঁতে ছিলাম ঘাস, হয়ে গেল বাঁশ। আর করো না ভুল, এবার তাড়াও দুই ফুল।’ কিংবা ‘কাজ পায় না শহর গ্রাম, মোদী মমতা দুই সমান’।