টাকা বদলের লাইনে দাঁড়ানোর দিনগুলো

গত পাঁচ বছরে নানা ঘটনায় প্রগাঢ় ছাপ পড়েছে জনজীবনে। কখনও খুশি, কখনও ক্ষোভ, কখনও আশঙ্কা দুলিয়ে দিয়েছে দেশকে। ভোটের মুখে কতটা ফিকে সেই সব ছবি, কতটাই বা রয়ে গিয়েছে পুরনো ক্ষতের মতো? খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার। 

Advertisement

সুস্মিত হালদার 

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৯ ০১:৫৫
Share:

নোটবন্দির স্মৃতি কি ইভিএমে ছাপ রাখবে?

স্টোভের উপরে জলের কেটলিটা বসাতে বসাতে নিজের মনেই গজগজ করে ছোটন। মাঝে সবাই ভুলে গিয়েছিল। ভোট আসায় আবার শুরু হয়েছে— সেই নোটবন্দি। সেই তর্ক- বিতর্ক। কিন্তু ছোটন যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। তার শুধু মনে আছে, একটা গোটা দিন দোকান বন্ধ রেখে তাকে ব্যাঙ্কে নোট পাল্টানোর লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল।

Advertisement

সমাজের একেবারে প্রান্তিক স্তরের মানুষ ছোটন। কৃষ্ণনগর পোস্ট অফিস চত্বরে তার ছোট্ট অস্থায়ী দোকান। যা আয় তাতে কোনও রকমে চলে যায় সংসার। নোটবন্দির ধাক্কা আছড়ে পড়েছিল তার উপরেও। শুনেছিল, এই কষ্ট স্বীকারে আখেরে ভালই হবে। আজ অবধি সে বুঝে উঠতে পারেনি, কী ভালটা হয়েছে।

কিন্তু যাঁরা বড় ব্যবসায়ী? যাঁদের ব্যবসায় দিনে লক্ষ-লক্ষ টাকা লেনদেন হয় তাঁরা কী ভাবছেন? কী প্রভাব পড়েছে তাঁদের উপরে?

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নদিয়া জেলার যুগ্ম সম্পাদক গোকুল সাহা বলছেন, “ওই সময়ে তিন-চার ধরে ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ক্ষতি যা হয়েছিল, এখনও সামাল দেওয়া যায়নি। তবুও তা মেনে নিতাম, যদি দেখতাম তাতে কাজ হয়েছে।” তাঁর প্রশ্ন, “ব্যবসাদারদের এত ক্ষতি হল, তাঁরা নানা ভাবে হয়রান হলেন, অথচ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলছে যে প্রায় সব টাকাই ফেরত এসেছে। কালো টাকা ধরা পড়ল?”

নোটবন্দির সময় চরম সঙ্কটে পড়েছিলেন তাঁত ব্যবসায়ী ও শিল্পীরা। তাঁদের ব্যবসা দাঁড়িয়ে থাকে নগদ লেনদেনের উপরে। দূরদূরান্ত থেকে হাটে কাপড় কিনতে আসা মানুষদের কাছ থেকে চেকে টাকা নেওয়ায় ঝুঁকি থাকে। যদি সেই চেক বাউন্স করে তা হলে কিছু করার থাকে না বা হয়রানির শিকার হতে হয়। নোটবন্দির সময়ে তাই গোটা তাঁত কাপড়ের ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল। শান্তিপুর তাঁত ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি তারক দাস বলছেন, “সেই সময়ে অনেকেরই সর্বস্বান্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সেই ধাক্কা এখনও সামলে ওঠা যায়নি। এত কিছুর পরেও তো কালো টাকা ফেরত এল না!”

প্রবল সঙ্কটে পড়তে হয়েছিল ওষুধের ব্যবসায়ীদেরও। তাঁদের ব্যবসা কিছুটা নগদে, কিছুটা ধারে হয়। বছরের শেষে একেবারে হিসাব করে সেই ধার শোধ করেন তাঁরা। নোট বাতিলের সময়ে দু’টি ক্ষেত্রেই সঙ্কট তৈরি হয়েছিল। প্রথমত, নগদ টাকার অভাবে ব্যবসা প্রায় বন্ধের মুখে পড়ে। আবার খুচরো ব্যবসায়ীরা বছরের মাঝপথে পুরনো নোট দিয়ে তাঁদের ধার পরিশোধ করতে শুরু করেন। ফলে এক দিকে বিক্রি অস্বাভাবিক ভাবে কমে যায়, অন্য দিকে প্রচুর নোট জমা হতে থাকে বড় বা মাঝারি ব্যবসায়ীদের হাতে। অথচ সেই নোট ব্যাঙ্কে জমা দিতে গিয়ে হয়রানির মুখে পড়তে হয়। যার রেশ রয়ে গিয়েছে এখনও। বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যন্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের নদিয়া জেলা ইউনিটের সহ-সভাপতি গোপীনাথ দে-র মতে, “নোটবন্দি একটা অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কালো টাকা তো উদ্ধার হলই না, উল্টে ব্যবসায়ীদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে গেল।”

বস্তুত সমাজের সর্বস্তরেই এর প্রভাব পড়েছে। তা সে সরকারি বা বেরসকারি চাকুরিজীবী হোন বা অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। সকলকেই দাঁড়াতে হয়েছে ব্যাঙ্ক পোস্ট অফিসের লাইনে। সকলকেই হয়রান হতে হয়েছে। ক’টা পাঁচশো টাকার নোট বদলে নেওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন নবদ্বীপের বাসিন্দা, জুট কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার অবসরপ্রাপ্ত কর্মী হিমাংশু সাহা। তিনি। সেই সময়টার কথা উঠলে আজও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন বছর সত্তরের বৃদ্ধ। ঝেঁঝে উঠে বলেন, “ভাবুন এক বার! আমার সৎ পথে আয় করা টাকা। অথচ দিনের পর দিন এ ব্যাঙ্ক ও ব্যাঙ্কের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। যাদের কালো টাকা আছে বলে জানি, তাদের কাউকেই কিন্তু সে দিন লাইনে দাঁড়াতে দেখিনি। বুঝি না, কোন জাদুবলে তাদের কালো টাকা সাদা হয়ে গেল!”

কথায় বলে, জনতার স্মৃতি ভারী দুর্বল। নোটবন্দির স্মৃতি কি ইভিএমে ছাপ রাখবে? কে বলতে পারে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন