MAsks

লোকাল বাজারে মাস্কই গলকম্বল, মাস্কই কুমিরছানা

কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ হাত তুলে বাইক থামালেন। জানতে চাইলেন, " মাস্ক কোথায়?" মাঝবয়সী আরোহী নির্বিকার মুখে বললেন, "মাস্ক কিনতেই যাচ্ছি।  বাড়িতে মাস্ক ফুরিয়ে গিয়েছে।"

Advertisement

সুদীপ ভট্টাচার্য 

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২০ ০৪:২৩
Share:

গলায় ঝুলছে মাস্ক, কারও বা কানে। কৃষ্ণনগরে। নিজস্ব চিত্র

সাঁ-সাঁ গতিতে পোস্ট অফিস মোড়ের দিকে ছুটে আসছিল কালো একটা দামি মোটরবাইক। আরোহীর মুখে মাস্ক নেই।

Advertisement

নদিয়ার জেলাসদর কৃষ্ণনগর। বুধবার, বেলা ১০টা বেজে গিয়েছে।

কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ হাত তুলে বাইক থামালেন। জানতে চাইলেন, " মাস্ক কোথায়?" মাঝবয়সী আরোহী নির্বিকার মুখে বললেন, "মাস্ক কিনতেই যাচ্ছি। বাড়িতে মাস্ক ফুরিয়ে গিয়েছে।"

Advertisement

জবাব শুনে মাথা গরম হলেও কিছুই করার নেই। কারণ বাড়ি ফিরে যেতে বলা ছাড়া অন্য কোনও ‘দাওয়াই’ দেওয়ার ছাড়পত্র নেই পুলিশের কাছে। পথচলতি কেউ ফুট কাটলেন, "ধরে পেটানো দরকার!" পাশ থেকে কেউ বা বিধান দিলেন, "কান ধরে ওঠবস করালে

যদি শোধরায়!"

আশপাশে দাঁড়িয়ে যাঁরা জ্ঞানগর্ভ মন্তব্য করছেন, তাঁদের সকলেরই মাস্ক আছে। তবে কারও মাস্ক থুতনির নীচে, কারও মাস্কের উপর দিয়ে নাকের ফুটো দিব্যি উঁকি মারছে ভাসমান জলহস্তীর মতো। বলতে গেলেই ঝামেলা বেধে যাবে।

যাঁরা মাস্ক না-পরেই বা নিদেনপক্ষে পকেটে নিয়ে ঘুরছেন তাঁদের আবার নানা অজুহাত। কেউ বলবেন, "এই তো পরেছিলাম, একটু চা খাব বলে মাস্ক খুলেছি!" কেউ গলা চড়িয়ে— "সিগারেটটাও কি খেতে দেবেন না?” এক বৌদি আবার মুচকি হেসে বলছেন, "মাস্কে লিপস্টিক লেগে যায় যে!" সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে, “বাবা, দম আটকে আসে!“ কেউ নাছোড়, “উল্টো দিকের লোকে কথা বুঝতে পারছে না মশাই!” কেউ আবার যাও বা লক্ষ্মীছেলের মতো মাস্ক পরে আছেন, সামনে এসে কথা বলার সময়েই মুখের একটু নীচে নামিয়ে নিচ্ছেন।

সে দিন কৃষ্ণনগরের একটি পেট্রল পাম্পে মাস্ক ছাড়াই তেল নিতে হাজির এক যুবক। পাম্পের কর্মচারী তেল দিতে অস্বীকার করলে তার সাফাই, "কাল রাতে প্যান্টের পকেটে মাস্ক রেখেছিলাম। আজ অন্য প্যান্ট পরে চলে এসেছি। মাস্ক ওই প্যান্টের পকেটেই থেকে গিয়েছে।" সত্যিই তো! ছাপোষা গেঞ্জি কাপড়ের মাস্ক বাহারি রুমালের মতো বুকপকেটে, সাইডপকেটে গুঁজে রাখা অনেকেই বেশ রপ্ত করে ফেলেছেন। মাস্ক কোথায় শুধোলেই কুমিরছানা বের করে দেখিয়ে দিচ্ছেন— "এই তো!"

যে কোনও দিন সকালে কৃষ্ণনগর পাত্রবাজারে ঢুকলেই দেখা যাবে অধিকাংশ ক্রেতা-বিক্রেতার থুতনির নীচে ঝুলছে মাস্ক। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করলে কেউ মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন, কেউ বা টুক করে মাস্কটা নাকের ওপর টেনে নিচ্ছেন। অনেকের আবার সেটুকুরও বালাই নেই, নিজের এলাকায় ‘শের খাঁ’। ক’দিন আগেই জাতীয় সড়কের পাশে দু’জনকে খোলা নাক-মুখে হাওয়া খেতে দেখে জিজ্ঞাসা করা গেল, "মাস্ক কই?" সহাস্যে উত্তর এল, "আমরা লোকাল, অসুবিধা নেই।"

দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে রোজ অসংখ্য মানুষ কৃষ্ণনগর আসেন চিকিৎসার জন্য। তাঁদের অনেকেরই মাস্ক থাকে না। বাসে বা অন্য কোনও ভাড়াগাড়িতে এসে কেউ হাসপাতালে, কেউ বা ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারের দিকে ছোটেন। মাস্কের কথা তুললেই বাঁধা উত্তর, " তাড়াহুড়োয় বাড়িতে ফেলে এসেছি।" কেউ বা উত্তর না দিয়ে ঝটপট রুমালে বা আঁচলে মুখ ঢেকে নেবেন।

রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের তো কিছু বলারই উপায় নেই। তাঁরা দিব্যি মিটিং-মিছিল, অবরোধ-উদযাপন চালিয়ে যাচ্ছেন। কারও মাস্কের বালাই নেই, কারও গলকম্বল, কারও বা কণ্ঠহার। কথাটা এক বার তুলে দেখুন! ছোট নেতা বলবেন, "আমাদের সঙ্গে এত মানুষ, অত নিয়ম কি মেনে চলা যায়?" মেজো নেতা আর্থ-সামাজিক অ্যাঙ্গেল দেবেন, "লোকের পেটে খাবার নেই, মাস্ক পরবে কী করে?" আর বড় নেতা হুতোমের মতো চোখ পিটপিট করে বলবেন, “বটেই তো, খাবার আর মাস্ক দুটোই জরুরি ইস্যু। ছেলেপিলের দল বোঝে না। আমি বলে দেব’খন।“

শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক ব্রজেশ্বর মুখোপাধ্যায় বলেন, "প্রতি দিন পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ভ্যাকসিন হাতে পেতে এখনও কয়েক মাস তো বটেই। এখন পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাস্ক পরা ভীষণ জরুরি।" কৃষ্ণনগরের প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা অন্যতম প্রশাসক অসীম সাহা বলেন, "শহরের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছেন না। যেহেতু পুরসভা সরাসরি কোনও ব্যবস্থা নিতে পারে না, তাই পুলিশ-প্রশাসনের কাছে দাবি রাখছি, নিরাপত্তার স্বার্থে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।"

নতুন দফার লকডাউনের বাজারেও পাবলিকের হুঁশ কি ফিরবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন